ঠিকানা: টালিগঞ্জ
কার্যকাল: ১৯৩৪-
প্রথম ছবি: সাবিত্রী (১৯৩৩, ইন্ডিয়া ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যানারে)
ইন্ডিয়া ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে কালী ফিল্মস। কালী ফিল্মস থেকে টেকনিশিয়ান্স স্টুডিও। দীর্ঘ পরিক্রমা। ম্যাডান কোম্পানি ছেড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্মস গড়েছিলেন প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়। মন বসল না সেখানেও। বেরিয়ে এসে তৈরি করলেন ইন্ডিয়া ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিজ। টালিগঞ্জ ট্রাম-ডিপো পেছনে ফেলে খানিক এগোলেই বাঁ দিকে এই স্টুডিও। ১৯৩৩ সাল সেটা। পূর্ণাঙ্গ স্টুডিও তৈরি করতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, সেটা তখন ছিল না প্রিয়নাথের কাছে। তবু তিনি বসে থাকলেন না। জোড়াতালি দিয়ে ছবির কাজ শুরু হয়ে গেল। প্রথম ছবি ১৯৩৩-এর এপ্রিলে মুক্তি পাওয়া ‘সাবিত্রী’। দ্বিতীয় ‘বিল্বমঙ্গল’ (১৯৩৩) মুক্তি পেল ডিসেম্বরে। স্টুডিও যখন ঝড়-ঝাপটা কাটিয়ে ক্রমশ সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, প্রিয়নাথের জীবনে নেমে এল আকস্মিক বিপর্যয়। পুত্র কালীধন বিলেত যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। ১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মারা গেলেন হঠাৎ। তাঁর স্মৃতিতে ইন্ডিয়া ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিজের নাম হল কালী ফিল্মস। ঋণমুক্তি, তরুণী, তুলসীদাস, পাতালপুরী...ছবি উঠতে লাগল পরপর। জ্যোতিষ মুখোপাধ্যায়, সুশীল মজুমদার, সুকুমার দাশগুপ্তরা এলেন এখানে ছবি করতে। চিত্রসম্পাদক জ্যোতিষ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনার হাতেখড়িই হল এখানে। আর প্রিয়নাথ নিজে তো ছিলেনই। বাংলা ছবির পাশাপাশি হিন্দি (মডার্ন লেডি, আশিয়ানা), উড়িয়া (প্রশ্ন, সীতার বিবাহ), উর্দু (আমিনা), তামিল (গুল বকাওয়ালী) ছবিও তৈরি হল এই স্টুডিওতে। ১৯৩৯ সালে কালী ফিল্মস স্টুডিওকে লিমিটেড করে নেওয়া হয়। এর পরের বছর প্রিয়নাথ স্টুডিওর দায়িত্ব ছেড়ে স্বাস্থ্যহানির জন্যে কলকাতার বাইরে চলে যান। তাঁর অনুপস্থিতিতে চল্লিশের দশকে কালী ফিল্মসের নিজস্ব প্রযোজনার জোর কমে এল। স্টুডিও ভাড়া দিয়ে অন্য ছবির কাজই হতে লাগল বেশি। কিন্তু টানতে পারল না বেশি দিন। ফটকে চাবি পড়ে গেল। হাই কোর্টের হস্তক্ষেপে রিসিভার হিসেবে স্টুডিও আবার ফেরত পেলেন বৃদ্ধ প্রিয়নাথ। কিন্তু স্টুডিওর ভবিষ্যৎ কী? এগিয়ে এলেন কয়েক জন তরুণ টেকনিশিয়ান। ১৯৫১ সালে আশুতোষ নাগ, দুর্গাদাস মিত্র, কল্যাণ মৈত্র এবং রামানন্দ সেনগুপ্ত রিসিভারের কাছ থেকে নিলেন স্টুডিও। এ বার তার নাম হল টেকনিশিয়ান্স স্টুডিও। শব্দযন্ত্রী সত্যেন চট্টোপাধ্যায় তাঁর দুই সহকারী দেবেশ ঘোষ এবং মৃণাল গুহঠাকুরতাকে নিয়ে এখানে যোগ দিলেন। নতুন রক্ত, নতুন প্রাণ নিয়ে টেকনিশিয়ান্স স্টুডিও তার কাজ শুরু করল। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে আবার কালো মেঘ। বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য খরচ প্রচুর বেড়ে গিয়ে ধারদেনা হল। মূলধনে টান পড়ল। জমির মালিক উচ্ছেদের মামলা ঠুকলেন। টেকনিশিয়ানদের আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৯৭৯ সালে বামফ্রন্ট সরকার এই স্টুডিও অধিগ্রহণ করে। বর্তমানে নতুন করে সংস্কার হয়েছে স্টুডিওর। প্রিয়নাথের প্রাণের কণা আজও বেঁচে আছে।
পুনশ্চ
ঋত্বিক ঘটক সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন টেকনিশিয়ান্স স্টুডিওতেই। নাগরিক, অযান্ত্রিক, মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, সুবর্ণরেখা, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো, এই সবই টেকনিশিয়ান্সে তৈরি। নাগরিক-এর শুটিং যখন হচ্ছে, টেকনিশিয়ান্স-এর একেবারের শুরুর দিক। কালী ফিল্মস থেকে বিক্রি হয়ে যাওয়া সাজসরঞ্জামের একটা অংশ নিলামে কেনা হয়েছে ফের। কোনও রকমে একটা ক্যামেরা আর অল্প কিছু আলো জোগাড় হয়েছে। তাই দিয়েই তৈরি হল নাগরিক। পরে ওই ক্যামেরা ভাড়া নিয়েই ‘পথের পাঁচালী’র শুটিং হয়।