পর্দার পিছনে

প্রথম পাতা > পর্দার পিছনে

চারুলতা

নামে কী আসে যায়, বলেন অনেকেই। অথচ নামের মধ্যে ধরা থাকে কত কিছুই। সত্যজিৎ রায় যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নষ্টনীড় গল্প থেকে ছবি করা মনস্থ করলেন, ছবির নাম হিসেবে নষ্টনীড়ই ওঁর মাথায় ছিল। প্রথম দিককার বিজ্ঞাপন, পোস্টার ইত্যাদি নষ্টনীড় নামেই হয়েছিল। কিন্তু ছবির নাম রেজিস্ট্রেশন করাতে গিয়ে দেখা গেল, নষ্টনীড় নামে একটি ছবি হয়েই আছে। এম পি প্রোডাকশন্সের নষ্টনীড়, সুনন্দা দেবী, কমল মিত্র এবং উত্তমকুমার অভিনীত নষ্টনীড় মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫১ সালের ২৪ অগস্ট। পরিচালক ছিলেন পশুপতি চট্টোপাধ্যায়। একই নামে আবার ছবি হলে গুলিয়ে যেতে পারে দর্শকের। সত্যজিৎ প্রথমে দুটো নাম ভাবেন, অমল আর ভূপতি। কিন্তু শেষে চারুলতা নামটাই ওঁর মনে ধরে। আর ওই নামটাই ছবির জন্য অমোঘ হয়ে ওঠে। 

এ ছবির বিখ্যাত দোলনার দৃশ্য যেখানে মাধবী মুখোপাধ্যায় গুন গুন করে ফুলে ঢলে ঢলে গাইছেন, নিজের এক স্মৃতিচারণে মাধবী জানিয়েছেন, ওই দৃশ্যটির শুটিং হয়েছিল শিবপুরের বিই কলেজে।  

চারুলতা মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালের ১৭ এপ্রিল  শ্রী, প্রাচী আর ইন্দিরাতে।

আকালের সন্ধানে

 'অস্বাভাবিক রকম স্বাভাবিক'। স্মিতা পাটিলকে এই ভাবেই বর্ণনা করতেন মৃণাল সেন। প্রথম বার স্মিতাকে দেখে, বিশেষত স্মিতার চোখ দুটো দেখে অবিকল মিল খুঁজে পেয়েছিলেন গীতা সেনের সঙ্গে। অভিনেত্রী গীতা সেন মৃণালের স্ত্রী। আর স্মিতা অভিনয় করতে এসেছেন আকালের সন্ধানে ছবিতে। মৃণাল লিখেছেন, স্মিতা এতই মাটির মানুষ ছিলেন যে ওঁকে দেখে নায়িকা বলে মনেই হত না। কিন্তু ক্যামেরা চালু হওয়া মাত্র অবলীলায় চরিত্রের মধ্যে ঢুকে যেতেন। ওঁর মুখশ্রীতে একই সঙ্গে একটা লজ্জা আবার সেই সঙ্গে নিজেকে প্রকাশ করার দৃঢ়তা ফুটে উঠত। 

স্মিতা নিরামিষাশী ছিলেন। এখানে ইউনিটের বাকি সকলেই মাছ মাংস খেতেন। স্মিতা নিজেই একটা আলাদা স্টোভে নিরামিষ রান্না করে নিতেন। একদিন ওঁর অভিনয় না থাকা সত্ত্বেও চলে এলেন।মৃণাল সেনের কাঁধে হাত রেখে শুটিং দেখতে থাকলেন। দৃশ্যটি ছিল, একজন মহিলা সদ্য বিধবা হয়েছেন। আরও দুজন মহিলা তাঁকে সামলাচ্ছেন আর বিধবা মহিলাটি অঝোরে কেঁদে বলছেন, "আমি আর ও ঘরে যেতে পারব না"। হঠাৎ মৃণাল বুঝতে পারলেন যে স্মিতার হাত তাঁর কাঁধটা চেপে ধরেছে এবং স্মিতা নিজে কেঁদে চলেছেন।

এই রকম ঘটনা আরও একবার ঘটে স্মিতাকে একটি দৃশ্য বোঝানোর সময়। শুটিংয়ের একদিন আগে দুপুরে খেতে বসে মৃণাল স্মিতাকে দৃশ্যটি বোঝাতে শুরু করলেন। দুর্গা (শ্রীলা মজুমদার) নামে একটি চরিত্রের সঙ্গে স্মিতার কথোপকথন। দুর্গা স্মিতার বাড়িতে কাজ করে। দুর্গার ছেলে অসুস্থ জেনে তাকে বাড়ি থেকে বেরোতে বারণ করে স্মিতার চরিত্রটি তাকে মাইনের টাকা দিতে চায়। কিন্তু দুর্গার পক্ষাঘাতগ্রস্ত বর তাকে সেই টাকা নিতে দেয় না। সে ওই ভাবে টাকা নেওয়ায় বিশ্বাসী নয়। শেষে দুর্গা স্মিতাকে টাকা ফেরত দিয়ে বলে যে সে আর কাজে আসবে না। 

পুরোটা শোনার পর, মৃণাল লিখছেন, স্তম্ভিত স্মিতার চোখ দুটো জলে ভরে যায়। মাথা নামিয়ে নিজের থালায় কিছুক্ষণ আঙুল বুলিয়ে তিনি বলে ওঠেন, "আমি কি একবারের জন্য দুর্গার সাথে দেখা করতে পারব না?"  স্মিতার আর সেদিন দুপুরে খাওয়া হয়নি। কিছুক্ষণের জন্য সিনেমার চরিত্র যেন আসল মানুষটির ওপর চেপে বসেছিল। 

অতল জলের আহ্বান

চলচ্চিত্র জগতে একজন ভাল গাইড পেলে অনেক বিষয়ে জানা যায়। গল্প আছে, ছবি বিশ্বাস সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে এতই ভালবাসতেন যে, প্রবীণ অভিনেতা তাঁর অনুজকে যেখানে সম্ভব সুযোগ দিয়ে তাঁর অভিনয় কুশলতা আরো যাতে বাড়তে পারে,তার জায়গা করে দিতেন। স্টার থিয়েটারের মালিক সলিল মিত্র একদিন সৌমিত্রকে নিয়ে গেলেন স্টেজের পিছনে সেই ঘরে যেখানে ছবি বিশ্বাস বসতেন। তারপর সৌমিত্র যাতে ওই থিয়েটারে যোগ দেন সে বিষয়ে ছবিবাবু কতটা চাপ দিয়েছেন, সে কথা ফাঁস করলেন। কারণ?খুবই সোজা। এতে স্টার থিয়েটারেরই শুধু উপকার হবে তাই নয়,সৌমিত্রও কিছু শিখতে পারবেন। অজয় করের 'অতল জলের আহ্বান' ছবির শুটিং চলার সময় সৌমিত্র তার আঁচ পেয়েছিলেন। বাবা-ছেলের অভিনয়ে একটা ৬ মিনিট লম্বা শট ছিল। কোন কারণে সৌমিত্র ঠিক পারছিলেন না। কয়েকবার চেষ্টার পর বিফল সৌমিত্র প্রবীণ অভিনেতার কাছে গিয়ে হাত কচলে বললেন, "কেমন করে করব, একটু দেখিয়ে দেবেন?" ছবিবাবু তার দিকে তাকিয়ে সোজা বললেন,"তা হলে তুমি বুঝেছ, যে তুমি পারছ না?" সৌমিত্র তো স্বীকার করতেই রাজি। "সে তো বটেই, তাই তো আপনাকে দেখিয়ে দিতে বলছি"। তার পর এ রকম ব্যবস্থা হল যে, ছবিবাবু সৌমিত্রর কথাগুলো বলবেন। অভিনয়ের সময় যে জায়গাটায় সৌমিত্রর আটকে যাচ্ছিল, সেখানে ছবিবাবু একটু থামলেন। তার ভুল শুধরে দিয়ে বললেন, "বুঝতে পারছ?" সৌমিত্র মাথা নাড়ার পর তাকে ওই অংশটা করতে বলা হল। সৌমিত্র ভুলটা ঠিক করে নিয়েছেন দেখে ছবি বিশ্বাস বললেন,"শিখে নাও, শিখে নাও, আর কবে শিখবে?" শ্রী, লোটাস ও ইন্দিরা প্রেক্ষাগৃহে এই ছবি মুক্তি পায় ২৫ শে মে, ১৯৬২। ছবি দেখার সময় দর্শকরা জানতেও পারেননি বাবা-ছেলের অভিনয়ে কোথায় গোলমাল হয়েছিল।

পথিক

চলচ্চিত্রের প্রচারকৌশল কি কোন স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে দিতে পারে!! আজ্ঞে হ্যাঁ,পারে। তরুণ মজুমদার যখন টালিগঞ্জে একেবারে নতুন, কাকার সঙ্গে গিয়েছিলেন প্রবীণ পরিচালক দেবকী বসুর বাড়িতে। তাঁর কাকা অমৃতবাজার পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন তো বটেই, আনন্দবাজারের সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে 'অনুশীলন এজেন্সি' নামে একটা প্রচার সংস্থাও তৈরি করেছিলেন। কাজের চাপে অথবা স্রেফ ভুলে যাওয়ার কারণে, ওই সাক্ষাৎকারের আগে দেবকী বসুর 'পথিক' ছবির বিজ্ঞাপনের কোন লে-আউট তৈরি হয়নি। এত কম সময়ে অনেকগুলো লেআউট তৈরি করে দিতে কোন চিত্রশিল্পীই রাজি হলেন না। অগত্যা কিছু একটা তৈরি করার ভার পড়ল তরুণ মজুমদারের ওপর। জানা ছিল এইটুকুই যে, শম্ভু-তৃপ্তি মিত্র অভিনীত এই ছবিটির বিজ্ঞাপন কাগজে এক সপ্তাহ চলবে। শম্ভু-তৃপ্তি মঞ্চে বিরাট অভিনেতা, কিন্তু সেই অর্থে সিনেমার তারকা নন; তাই তরুণবাবু বিজ্ঞাপনের তাঁদের ছবি আনতে চাইলেন না। তিনি একটা কাগজ নিয়ে এক কলাম মাপে কেটে নিলেন। ভাবনাটা ছিল, প্রথম দিন একটা কলাম ফাঁকা থাকবে,কোন নাম নয়, ছবি নয়। ফাঁকা জায়গা কৌতূহল জাগাবে। পরের দিন থাকবে ব্যাগ কাঁধে একজনের আলোকচিত্র, পিছন ফিরে হেঁটে যাচ্ছেন। মুখটা দেখা যাচ্ছে না। তৃতীয় দিন দেখা যাবে, সে আরো কিছুটা হেঁটে যাচ্ছে, সামনে কয়েকটা পায়ের দাগ। তারপর ওই লোকটা মিলিয়ে যেতে যেতে চেহারাটা ছোট হয়ে সপ্তম দিনে পুরো মিলিয়েই যাবে। তলায় লেখা থাকবে: চিত্রমায়া প্রযোজিত দেবকী বসু পরিচালিত পথিক। এই সুন্দর উদ্ভাবন কিন্তু তরুণবাবুর কাকা বা তার সঙ্গীর পছন্দ হয়নি। তাঁরা তরুণকে ওগুলো লুকিয়ে রাখতে বললেন। কোন মতেই যেন দেবকীবাবুর নজরে না আসে। ঠিক হল একজন শিল্পীর অনিচ্ছায় করা লে-আউটটাই তাঁকে দেখানো হবে। যা ভাবা গিয়েছিল, দেবকীবাবুর মোটেই পছন্দ হল না ওই লে-আউট। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, রুমাল খুঁজতে গিয়ে আচমকা তরুণবাবুর পকেট থেকে তাঁর করা ডিজাইনগুলো মাটিতে পড়ে যায়। দেবকীবাবু কী ভাবে যেন তাঁর ছবির নামটা দেখতে পেয়েছিলেন এবং কৌতূহল বশে তিনি ওগুলোও দেখতে চাইলেন। ঠিক এই রকমই তিনি চাইছিলেন, বললেন দেবকী বসু। সবাই হতবাক! ততক্ষণে দেবকীবাবুর নির্দেশ পাওয়া গেছে: "তরুণকে রোজ আমার কাছে পাঠিয়ে দিও; আর হ্যাঁ ,ওকে কাজ করার স্বাধীনতা দাও।" 'পথিক' চলচ্চিত্রের প্রচার পরিকল্পনা তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। ওই ছবির মুক্তি: ১৫ই মে ১৯৫৩; শ্রী-পূর্ণ-ছায়া হলে। ওই বিজ্ঞাপনের গুণে 'অনুশীলন এজেন্সি'র কাছে বেশি বেশি লোক আসতে লাগল তো বটেই, বাংলা চলচ্চিত্রের এক প্রবীণ এবং এক হবু দিকপালের মধ্যেও গড়ে উঠল এক দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক।

পদিপিসির বর্মিবাক্স

১৯৭২ সালের কথা। বাংলার এক দূর গ্রামে শুটিং চলছে। ছবির নামটা লম্বা: "পদিপিসির বর্মিবাক্স"। কৌতূহলী লোকজন জানতে চায়: কিসের শুটিং দাদা, কোন ছবির? অভিনেতাদের মধ্যে আছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, জহর রায়,চিন্ময় রায়। এত বড়ো নামটা বারবার বলা এক ঝকমারি! ভানুবাবু তাই একটা রাস্তা বার করলেন। "কেউ জিজ্ঞেস করলেই আমি বলব 'পদি', জহর বলবে 'পিসির', রবি উচ্চারণ করবে 'বর্মি' আর চিন্ময় শেষ করবে'বাক্স'। ব্যস, বলতে শুরু করা মাত্রই লোকের জানতে চাওয়া খতম! বলা বাহুল্য, ওই ভাবে নাম বলাটা লোকজনের মোটেই ভাল লাগেনি। সুফলটা এই যে, শুটিংটা নির্ঝঞ্ঝাটে হতে পারল।

চাওয়া পাওয়া

১৯৫৯— শচীন মুখোপাধ্যায়, তরুণ মজুমদার, দিলীপ মুখোপাধ্যায়— এই তিন জন ফিল্মপাগল মিলে গড়ে তুললেন 'যাত্রিক' পরিচালকগোষ্ঠী। তাঁদের প্রথম ছবি 'চাওয়া পাওয়া'য় আরেক ত্রয়ী: উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, ছবি বিশ্বাস। যাত্রিকের তিন জন যখন ছবিবাবুর কাছে যান, তিনি এক অবিশ্বাস্য দাবি করলেন: দিনে ৫০০ টাকা! সেকালের পক্ষে অবিশ্বাস্য! খুবই অল্প টাকায় প্রথম ছবি করতে নেমেছেন তিন নবীন। তাঁরা তো ভয়ে কিছু বলতে পারছেন না। অবশেষে প্রবীণ ছবিবাবুই মুখ খুললেন: 'তোমাদের প্রথম ছবি,আমি কম করে দিলাম'। তার পরে একটু দম নিয়ে বললেন: বেশ দিনে ২৫০ টাকা। তাঁরা তখনও চুপ। গভীর নীরবতা! আবার সেই ছবিবাবু: তোমরা কী চাইছ? আরো কমাই? তার পরে কী হয়েছিল, সে তো ইতিহাস হয়ে আছে।