পণ্ডিত রবিশঙ্কর একবার কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, "বাহাদুর এবং ঋত্বিক একসঙ্গে কাজ করেছেন বলেই বহুলপ্রসংশিত এই ফিল্মটির আবহসঙ্গীত এতটা মনোগ্রাহী হয়েছিল।'' তাঁদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বই কি তবে সুবর্ণরেখার সঙ্গীতের চিরন্তন
আকর্ষণের কারণ? ঋত্বিক ঘটকের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গুরু বাহাদুর খানের সৃষ্ট আবহের উৎকর্ষের অশ্রুতপূর্ব কারণগুলো পর্যালোচনা
করেছেন তাঁর শিষ্য,
পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার
বিএফএ এই কাজটার দায়িত্ব নিল কেন:
এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে সরোদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী ওস্তাদ বাহাদুর খানের কর্মজীবন সম্পর্কে অত্যন্ত স্বল্প তথ্যই নথিবদ্ধ রয়েছে। ঋত্বিক ঘটকের ফিল্মের জন্য তিনি যে সুরের ইন্দ্রজাল রচনা করেছিলেন সেই বিষয়েও সে ভাবে চর্চা করা হয়নি। একজন গুরুর সৃষ্টিকে তাঁর শিষ্যের চেয়ে বেশি আর কেই বা অনুভব করতে পারে? একজন প্রথিতযশা সরোদ শিল্পী হওয়ার পাশাপাশি, পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার খ্যাতনামা সঙ্গীত পরিচালকও বটে। সেই কারণেই, দুই প্রতিভার সম্মিলিত সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে এই নিবন্ধটি লিখতে আমরা তাঁকেই অনুরোধ জানিয়েছিলাম
আমার
জীবনের এই এতগুলো বছরে একবারই আমি সরোদ বাজাতে গিয়ে নার্ভাস বোধ করেছি। ইংল্যান্ড
থেকে কেউ একজন এসেছিলেন ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের অংশগুলি পুনর্নির্মাণ করবেন
বলে; সেই ব্যাপারে আমাকে একটা রেকর্ড করতে বলা হয়েছিল। ভদ্রলোক আমাকে ধরেছিলেন কারণ
আমি ওস্তাদ বাহাদুর খান সাহেবের শিষ্য। সুবর্ণরেখা ছবির (১৯৬৫) একটা অংশ বাজাতে গিয়ে
আমার হাত ঘেমে গেল। যে অনবদ্য সঙ্গীতের ভাবনা আমার নয়, তাকে আমি পুনর্নির্মাণ করি
কেমন করে?
সেটা
১৯৯০ সালের কথা। কৌশিকীর (চক্রবর্তী) তখন অনেক কম বয়স। তাকে গাইতে বলা হয়েছিল ভৈরবীর
একটা সহজ বন্দিশ - মোরা দুখুয়া- ছবিতে যেটা গেয়েছিলেন আরতি মুখোপাধ্যায়। আমার কাজ
ছিল আমার গুরু ওই গানের সঙ্গে যে সরোদ সঙ্গত করেছিলেন সেই অংশটুকু বাজানো। সেই বাজনাটা
শুনলে এখনো আমার চামড়ায় ফোসকা পড়ে, তখন মনে পড়ে যায় সেটা আবার বাজানোর চেষ্টা
করতে গিয়ে আমার স্নায়ু-মোচড়ানো অভিজ্ঞতা।
আমার গুরু কী করে এটা বাজিয়েছিলেন, ভেবে আমি নার্ভাস হয়ে যাই; কণ্ঠস্বর কোনখান থেকে বাজনাকে ধরছে, এটা আন্দাজ করাটা ছিল খুব কঠিন।
দৃশ্যটা ছিল এক রুক্ষ পটচিত্রে মাধবী মুখোপাধ্যায় (সীতা) আর অভি ভট্টাচার্য (ঈশ্বর)। ক্যামেরা ঘুরতে থাকে (প্যান করে) আর আমরা শুনি সরোদের সুর, ক্রমে তা মিশে যায় আরতিদির কণ্ঠস্বরে। সরোদ ছাড়াও পণ্ডিতজী ব্যবহার করেছিলেন পাখোয়াজ, ভাইব্রাফোন আর সুরমন্ডল। এর ফলে যে অনুভব সৃষ্টি হয়, তা একই সঙ্গে শান্ত এবং তীক্ষ্ণ। আমার গুরু কী করে এটা বাজিয়েছিলেন, ভেবে আমি নার্ভাস হয়ে যাই; কণ্ঠস্বর কোনখান থেকে বাজনাকে ধরছে, এটা আন্দাজ করাটা ছিল খুব কঠিন। অজয়দাও (পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী) সেই কাজটার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
আমরা দুজনেই রেকর্ডিংয়ের সময় একমত হই যে, দুটো স্বরের মধ্যে প্রভেদ করাটা খুব শক্ত। ওস্তাদ বাহাদুর খান সাহেব ওই বাজনায় এমন একটা মাত্রা নিয়ে এসেছিলেন যার অবস্থান সরোদ আর কণ্ঠস্বরের মাঝামাঝি কোথাও। আমি ওই বাজনাটা একশোবারের বেশি শুনেছি; তবু আমি জানি না ওই ভাবটা কী করে নিয়ে আসতে হয়।
ওস্তাদ বাহাদুর খান সাহেবের বাজনার অনন্যতা এই জায়গায় যে, তার ভেতর ধরা আছে ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তাঁর সখ্যের ছাপ। তাঁদের দুজনের সৌন্দর্যবোধ, আগ্রহের ক্ষেত্র এবং জীবনদর্শনে অনেক ঐক্যের জায়গা আছে।
আমার
দৃঢ় বিশ্বাস, কোন শ্রেষ্ঠ শিল্পসৃষ্টিকে পুনর্নির্মাণ করা যায় না।
বিশেষ করে তা যদি হয় একজনের গুরুর সৃষ্টি। ওই জাতীয় একটি কাজের সঙ্গে যুক্ত হবার
সুফল এই যে, ওই বাজনাটা সম্পর্কে আমার বোধ আরো গভীর হল এবং জানতে পারলাম, আরো কত কী
শেখার আছে। ওস্তাদ বাহাদুর খান সাহেবের বাজনার অনন্যতা এই জায়গায় যে, তার ভেতর ধরা
আছে ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তাঁর সখ্যের ছাপ। তাঁদের দুজনের সৌন্দর্যবোধ, আগ্রহের ক্ষেত্র
এবং জীবনদর্শনে অনেক ঐক্যের জায়গা আছে। ঋত্বিক ঘটকের ওই সিনেমাটা দেখতে গিয়ে সহজেই
বুঝতে পারি তাঁদের মিলের জায়গাটা - অনুভূতি আর সৃজনের ক্ষেত্রে তাঁরা কী ভাবে আত্মীয়তার
এক সমবাদনে পৌঁছেছিলেন। আমার গুরুর প্রধান শক্তি ছিল তাঁর সংযম। ঋত্বিকের মনে যা আছে,
তা তিনি প্রকাশ করতে পারতেন অল্প কয়েকটা যন্ত্র ব্যবহার করে। পন্ডিত রবিশঙ্করজীও একবার
আমাকে বলেছিলেন যে, ওই মানের বাজনা সম্ভব হয়েছিল, কারণ 'বাহাদুর
আর ঋত্বিক একসঙ্গে বসেছিলেন'।
প্রবীণেরা
বলেছেন, বাহাদুর খান সাহেব একবার রাশ দেখেই বলতে পারতেন, কোথায় আবহসঙ্গীতের প্রয়োজন
হবে। আমার গুরুর সাথে ঋত্বিকের এতটাই সমভাব ছিল যে তাঁর নির্দেশ তিনি সঙ্গে, সঙ্গে
ধরে ফেলতে পারতেন। আমার ধারণা, তাঁদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বই সুদৃঢ় করেছিল সৌন্দর্য বিষয়ে তাঁদের আত্মিক বন্ধনকে।
সেই সময় আমি শুনেছিলাম, বাহাদুর খান সাহেবের সঙ্গে শান্তি বর্ধনের যুগলবন্দী কতটা সমাদৃত ছিল। আমার মনে হয়, সেই সময়ই বাহাদুর খানের সঙ্গে ঋত্বিক ঘটকের পরিচয় হয়। ঋত্বিক বাহাদুর খানের থেকে দু'বছরের বড় হওয়া সত্বেও আমার ওস্তাদকে গুরু বলে বরণ করে নেন। ঋত্বিক আমার গুরুর গান্ডা বাঁধা শাগরেদ ছিলেন, কিন্তু তাঁর সরোদ বাদন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।
আজ
এটা ইতিহাস যে, আমার গুরু বিখ্যাত হয়ে ওঠেন
যখন তিনি উদয়শঙ্করের দলে একদা যুক্ত প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী শান্তি বর্ধনের নৃত্যনাট্যের
সঙ্গে ব্যবহৃত আবহসঙ্গীত পরিচালনার কাজ শুরু করেন। শান্তি বর্ধনের ব্যালে 'মেঘদূতে'র আবহসঙ্গীত প্রস্তুত করেছিলেন আমার ওস্তাদ। তাঁর
সেই কাজটি বহুল প্রশংসিত হয়েছিল।শান্তি বর্ধনের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী গুল বর্ধন
সেই ব্যালে পুনর্নির্মাণ করেন। সেই কাজে বাহাদুর খান সাহেবের সহকারী ছিলেন আমার পিতা
রঞ্জন মজুমদার। আমার সৌভাগ্য যে, আমি সেখানে বাজানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। সেটা ১৯৮০ দশকের
কথা। সেই সময় আমি শুনেছিলাম, বাহাদুর খান সাহেবের সঙ্গে শান্তি বর্ধনের যুগলবন্দী কতটা
সমাদৃত ছিল। আমার মনে হয়, সেই সময়ই বাহাদুর খানের সঙ্গে ঋত্বিক ঘটকের পরিচয় হয়।
ঋত্বিক বাহাদুর খানের থেকে দু'বছরের বড় হওয়া সত্বেও আমার ওস্তাদকে গুরু বলে বরণ করে
নেন। ঋত্বিক আমার গুরুর গান্ডা বাঁধা শাগরেদ ছিলেন, কিন্তু তাঁর সরোদ বাদন সম্পর্কে
বিশেষ কিছু জানা যায় না।
চলচ্চিত্রের আবহসঙ্গীত সম্পর্কে প্রত্যেক ধ্রুপদী শিল্পীর ধারণা আলাদা। আমার যত দূর জানা আছে, আমার গুরু কখনোই এমন সঙ্গীত সৃষ্টি করেননি যা চলচ্চিত্রটির বিষয়বস্তুকে ছাপিয়ে যায়। অল্প যন্ত্র সহযোগে তাঁর বাজনা হয়ে উঠত একটি দৃশ্যের পরিপূরক। সুবর্ণরেখা চলচ্চিত্রে সঙ্গীত-পরিচালক হিসাবে প্রথম আবির্ভাবের সময় থেকেই তিনি এই স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
আমরা একটা চাবুকের শব্দ শুনি। ওই শব্দটা তৈরি করা হয়েছিল তার সানাইয়ের শব্দের সঙ্গে চাবুকের শব্দ মিশিয়ে। দীর্ঘ ছেদের মাঝখানে কশাঘাতের সঙ্গে তার সানাইয়ের ছড়াঘাত মিশিয়ে তৈরি এই বাজনা (লোকেশন সাউন্ড) চলচ্চিত্রে আবহ সঙ্গীতের এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে আমার মনে হয়।
সেই দৃশ্যটির কথা ভাবুন: অভি ভট্টাচার্য গণিকালয়ে এসেছে। মাধবী মুখোপাধ্যায় তাকে দেখা মাত্রই চিনতে পেরেছে। দাদাকে সেই আঘাত থেকে বাঁচাতে সে নিজের গলা কেটে ফেলল। এই দৃশ্যে আমার গুরু শুধুমাত্র তার সানাই ব্যবহার করেছেন নাটকটা উচ্চগ্রামে নিয়ে যেতে চেয়ে। আমরা একটা চাবুকের শব্দ শুনি। ওই শব্দটা তৈরি করা হয়েছিল তার সানাইয়ের শব্দের সঙ্গে চাবুকের শব্দ মিশিয়ে। দীর্ঘ ছেদের মাঝখানে কশাঘাতের সঙ্গে তার সানাইয়ের ছড়াঘাত মিশিয়ে তৈরি এই বাজনা (লোকেশন সাউন্ড) চলচ্চিত্রে আবহ সঙ্গীতের এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে আমার মনে হয়। অতিনাটকীয়তার বদলে এখানে আমরা পাই এক অসাধারণ সংযম আর মাত্রাবোধের পরিচয়। ন্যূনতম বাজনা ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ভাব নিয়ে আসার এক শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এই দৃশ্যটি।
একই
অনুভব সৃষ্টি হয়েছে ছবিটির সেই অংশে যেখানে বাহাদুর খান সাহেব আরতিদিকে দেশী রাগের
একটা সহজ বন্দিশ গাইতে দিয়েছিলেন। সেই গান শুধু একটা গান হয়ে থাকেনা; আবহসঙ্গীতে
রূপান্তরিত হয়ে, সাবেক সাদা-কালো ফ্রেমে সীতার একাকীত্বের দৃশ্যটিকে তা পৌঁছে দেয়
উচ্চতর শিখরে।
আমার
আরেকটি প্রিয় দৃশ্য: বিয়ের দিন মাধবীর পরিবার থেকে বেরিয়ে যাওয়া। বিয়ের দৃশ্যে
সানাইয়ে মালকুন, মারু বেহাগ এবং কেদার বাজানো খুবই পরিচিত। দৃশ্যটি অসাধারণ হয়ে ওঠে
রাগ নির্বাচনে - ওস্তাদ আলি আহমেদ হুসেনের সানাইবাদনে। তিনি নিয়েছিলেন দুটি ভিন্নজাতের
রাগ: গারা আর পুরিয়া ধ্যানেশ্রী; তাদের মিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল দুটি ভিন্ন মেজাজ
- (উৎসবের) উদযাপন আর (বিদায়ের) বিষাদ।
ছবির
শেষ দৃশ্যে যখন ক্যামেরা ফোকাস করে সীতার ছেলের
ওপর, যন্ত্রসঙ্গীত তখনো এক অন্যতর মাত্রা নিয়ে আসে। ছেলেটির মনে পড়ছে তার মায়ের
কথা। এখানে ব্যবহার করা হয়েছে ঘণ্টার শব্দ। ক্যামেরা দ্রুত এগিয়ে চলে, বাজনার সুরও
চড়তে থাকে। ঘন্টার শব্দের সঙ্গে জুড়ে যায় দোতারায় বাজানো: আজি ধানের ক্ষেতে - সেই
গান যা ছেলেটি তার মায়ের মুখে শুনেছিল।