নিবন্ধ

প্রথম পাতা > নিবন্ধ
সুভাষচন্দ্র (১৯৬৬) ছবির দৃশ্য। বাউল কণ্ঠে এক বার বিদায় দে মা শুনছেন বালক সুভাষ।
বহু রূপে বন্দে মাতরম: বাংলা সিনেমায় স্বাধীনতা সংগ্রামের আট দশক (দ্বিতীয় পর্ব)
তারিখ : 14-August-2023

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম লগ্ন থেকেই বাংলা ছিল তার পুরোভাগে। বাংলা ছবিতে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনী কতটাকেমন ভাবে এসেছে?  দুই পর্বের এই প্রবন্ধে আট দশকের বাংলা দেশাত্মবোধক ছবির পরিক্রমা করেছেন স্রগ্ধরামালিনী দাস। 


কেন  BFA  এমন একটি লেখার কথা ভাবল?


স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উদযাপন সমাপ্ত হতে চলেছে। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমরা ফিরে দেখতে চেয়েছি বাংলা দেশাত্মবোধক ছবির ধারাটিকে।  কী ভাবে আট দশক জুড়ে পর্দায় স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপায়ণে কতটা বদল এসেছে বা আসেনিসেটা তলিয়ে দেখাও আমরা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছি। ৯ অগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা দিবসকে স্মরণ করে আমরা এই লেখার প্রথম পর্ব পেশ করেছিলাম। এ বার রইল দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।

দেশনায়কদের আবাহন: অনন্য স্বাধীনতা যোদ্ধাদের উত্থান (১৯৬০-১৯৮০)

পূর্ববর্তী দশকের ছবিগুলিতে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্বে সূর্য এবং অজয়ের মতো চরিত্রদের দেখা গেলেও, চিত্রনাট্যে স্বতন্ত্র উন্নয়নের চেয়ে বিপ্লবী দলে তাদের ভূমিকাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬০- এর দশক থেকে কিন্তু জীবনীমূলক বা কল্পনাধর্মী ছবিগুলি একজন নায়ককে কেন্দ্র করে বানানো হতে লাগল যেমন সুভাষ চন্দ্র (১৯৬৬), মহাবিপ্লবী অরবিন্দ (১৯৭১) এবং সব্যসাচী (১৯৭৭)।

 

পরিচালক পীযূষ বসুর সুভাষচন্দ্র (১৯৬৬)  ছবিটিতে একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুর স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের পরিবর্তে দেখানো হয়েছে একজন স্বাধীনতা যোদ্ধা হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশের নেপথ্য কাহিনী। ছবিটিতে সুভাষের মাথার ওঠানামার আলংকারিক ব্যবহার তাঁর বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা ও সচেতনতা লাভের দিকে ইঙ্গিত করেতারই  বিবর্তনের পথ বেয়ে তিনি হয়ে ওঠেন আমাদের পরিচিত জাতীয় নেতা। তাঁর এই পরিবর্তন পোশাক পরিচ্ছদের বদলের মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে ছবিতে। প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুল থেকে একটি দেশীয় স্কুলে ভর্তি করা হলে সুভাষ প্রথমে সেখানে হ্যাট-সহ সম্পূর্ণ বিদেশি পোশাকে সজ্জিত হয়ে যান। কিন্তু নতুন স্কুলে তাঁর নিজেকে সংস্কৃত না জানা এবং আলাদা পোশাকের কারণে বেমানান বলে মনে হয়। স্বদেশী আদর্শে দীক্ষিত হবার পরে সুভাষ পোশাক হিসেবে বেছে নেন ধুতি এবং তাঁর এই সিদ্ধান্তের মুহূর্তটি চিত্রায়িত হয় "বাংলার মাটি, বাংলার জল" গানটির আবহে। তবে, স্বদেশের ধারণাটি এই ছবিতে  বাংলা প্রাদেশিকতার হাত ধরেই  এসেছে যা আরো বেশি পরিস্ফুট হয় বাংলার নৈসর্গিক দৃশ্যের বহুল ব্যবহারে।   

মহাবিপ্লবী অরবিন্দ (১৯৭১) ছবিতে একলা ঘরে গান গাইছে সুলতা।

ছবিটি কিন্তু শুধুমাত্র সুভাষের ব্যক্তিজীবন ঘিরে আবর্তিত হয়নি। বরং স্বাধীনতা সংগ্রামী হয়ে ওঠার জন্য একান্তবাস এবং আত্মনিরীক্ষণের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেছে। অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যে আসা বা বইয়ে পড়া কিছু কথা নিয়ে ভাবতে ভাবতে রাত্রিবেলা নিজগৃহে সুভাষের একা পায়চারির দৃশ্যে বিষয়টি ধরা পড়ে। একাকীত্বকে সুভাষের চরিত্রের একটি বিশেষত্ব রূপে দেখানো হয়েছে যা ছবির শেষ দৃশ্যে পুলিশ দ্বারা গ্রেপ্তার হয়ে চলে যাবার সময় দর্শকদের দিকে  তাঁর অবিচল ও দৃঢ় দৃষ্টিপাতে প্রকাশিত হয়।   

 

একই রকম ভাবে, দীপক গুপ্ত পরিচালিত মহাবিপ্লবী অরবিন্দ (১৯৭১) ছায়াছবিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে শ্রী অরবিন্দ ঘোষের উত্থান এবং পরবর্তী কালে তাঁর আধ্যাত্মিকতার প্রতি অনুরক্তির কাহিনী দেখানো হয়েছে। অরবিন্দের বিপ্লবী দলে একজন বাইজি তথা যৌনকর্মী, সুলতাকে গ্রহণের ঘটনাটি চিত্রনাট্যের ক্রমবিকাশের সহায়ক হয়। ( সব্যসাচী (১৯৭৭) এবং ফেরারি ফৌজের (২০০২) মতো ছবিতেও এ রকম স্বীকৃতি প্রদানের ঘটনা গল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে)। দলের কাজে সহায়তা করা সত্ত্বেও সুলতার প্রান্তিক অবস্থান সহজেই চোখে পড়ে। অন্য বিল্পবীরা যখন একসঙ্গে "বন্দে মাতরম" এবং "বঙ্গ আমার জননী আমার" গান গেয়ে বাংলার উন্মুক্ত মাঠময়দান দিয়ে দল বেঁধে এগিয়ে চলে, সুলতাকে দেখা যায় নিজের ঘরে একা বসে মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়"-এর মতো দেশাত্মবোধক গান গাইতে।  

এই সিনেমায়, একান্তে কাটানো সময়েই অরবিন্দকে পত্রপত্রিকায় কংগ্রেসের বিপক্ষে কিংবা রাজদ্রোহমূলক প্রবন্ধ লিখতে দেখা যায়। কারাগারে একাকী বন্দী থাকার সময় ধ্যানযোগে আধ্যাত্মিক জ্ঞানলাভ করেন তিনি। বারংবার, গীতা থেকে উদ্ধৃত বাক্যের ব্যবহার ছবিটিতে শুধু আধ্যাত্মিকতার বিশ্লেষণে সাহায্য করে তাই নয়বিপ্লবী আন্দোলনের মূলত হিন্দু ভাবধারার দিকটিতেও আলোকপাত করে। 

 

পরিচালক পীযূষ বসুর সুভাষচন্দ্র (১৯৬৬)  ছবিটিতে একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুর স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের পরিবর্তে দেখানো হয়েছে একজন স্বাধীনতা যোদ্ধা হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশের নেপথ্য কাহিনী।

প্রথম বার এক স্বতন্ত্র দেশনায়ককে ঘিরে পরিচালক পীযূষ বসু প্রস্তুত করেছিলেন তাঁর সুভাষচন্দ্র (১৯৬৬) সিনেমাটি। এর এক দশক বাদে সেই একই পরিচালকের সব্যসাচী (১৯৭৭) ছবিটি মুক্তি পায়। বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা, এই সিনেমার কাল্পনিক মুখ্যচরিত্র সব্যসাচীর ভারত, সিঙ্গাপুর, সাংহাই, হংকং সবজায়গার পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে, অসম্ভব চতুরতার সাথে, ছদ্মবেশে (তাঁকে দেখা যায় বাদাম বিক্রেতা, গাঁজাখো, ব্রাজিলিয়ান কোকো রপ্তানিকারক, মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী, খ্রিস্টান ধর্মযাজক - এমনকি সময়বিশেষে সুভাষ চন্দ্র বসু ও ভগৎ সিংয়ের মতো অতিপরিচিত সংগ্রামীদের মতো বেশভূষা ধরতে) ঘুরে বেড়ানোর ক্ষমতাই কিন্তু এর একমাত্র কারণ ছিলনা! সব্যসাচীর ভূমিকায় আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন বিখ্যাত অভিনেতা উত্তম কুমারের উপস্থিতিও ছিল এর কারণ।


ছবিটির চিত্রনাট্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সব্যসাচীর দলের সদস্যদের তাদের ওপর কর্তৃত্ব ফলানোর জন্য সব্যসাচীরই বিরোধিতা করতে দেখা যায় তবে এই ধরণের প্রতিবাদকে দ্রুত তিরস্কারের দ্বারা দমিয়ে দেওয়া হয়। গোটা ছবিতে সব্যসাচী যে লক্ষ্যপূরণের প্রয়াস করেন, শেষাংশে এসে সেই কাজটিতে কিন্তু অসফল হন। এই অসফলতার কারণে দল থেকে, বিশেষ করে প্রেমিকা রোজ/সুমিত্রার (প্রাক্তন দেহোপসারিনী, যে ভূমিকায় উত্তমের বাস্তব জীবনের সঙ্গিনী সুপ্রিয়া দেবীকে দেখা যায়) কাছ থেকে সব্যসাচী নিজেকে আরোই দূরে সরিয়ে নেন। তিনি একাই অন্যত্র নিজের পরিকল্পনাকে ফলপ্রসূ করার চেষ্টায় ব্রতী হন। এই ঘটনা আবারও বিপ্লবের পথে একলা চলার গুরুত্বকেই তুলে ধরে। 

তাহাদের কথা (১৯৯২) ছবিতে মিঠুন চক্রবর্তী।

বিফল প্রতিশ্রুতি, নাগরিকদের মোহভঙ্গ: স্বাধীনতা উত্তর যুগে জাতীয়তাবাদের পুনর্মূল্যায়ন(১৯৮০-২০১০)

 

১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর এমন অনেক সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটে যায়, যার ফলে জাতীয়তাবাদী আদর্শকে ঘিরে আগেকার উদ্দীপনা খানিক কমে আসে।  বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গকে বইতে হয়েছিল দাঙ্গা, দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, খাদ্য আন্দোলন এবং সর্বোপরি রক্তক্ষয়ী  সত্তরের দশকের ক্ষত। সাবেকি আদর্শবাদের উপরে এ সবেরই দীর্ঘ ছায়া পড়েছিল।  যে বাংলা স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ধাত্রীভূমি ছিল, সেই বাংলাতেই জাতীয়তাবাদী ভাবধারার ঝোঁক অনেকটা মিইয়ে গিয়েছিল।   


এক দিকে যেমন একবিংশ শতকের গোড়ার দিক অবধিও প্রশান্ত বলের তৈরি ফেরারী ফৌজের (২০০২) মতো সিনেমায় বাংলার এক কাল্পনিক গ্রাম ভুবনডাঙার পটভূমিতে, রূপক হিসেবে ব্যবহৃত বিপ্লবী দলের কর্মকাণ্ড, জঙ্গলে আত্মগোপন এবং অত্যাচারিত হয়েও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গল্প দেখানো হয়েছেতেমন অন্য দিকে ১৯৮০'র দশক থেকেই কিছু বাংলা সিনেমা স্বাধীনতা-পরবর্তী আশাভঙ্গের  প্রত্যুত্তর দিয়েছে। এই যুগের প্রথম দিকে তৈরি উৎপল দত্তর ছবি বৈশাখী মেঘে (১৯৮১) স্বাধীন ভারতে কমিউনিস্ট কর্মকাণ্ডে যোগ দেওয়ায় বিগত যুগের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করার করুণ পরিণতি দেখানো হয়।

 

এই যুগের প্রথম দিকে তৈরি উৎপল দত্তর ছবি বৈশাখী মেঘে (১৯৮১) স্বাধীন ভারতে কমিউনিস্ট কর্মকাণ্ডে যোগ দেওয়ায় বিগত যুগের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করার করুণ পরিণতি দেখানো হয়।

স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একই রকম স্বপ্নভঙ্গের উপাখ্যান  দেখানো হয়েছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবি তাহাদের কথায় (১৯৯২)। আট বছর বাদে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া, তিন বছর পাগলাগারদে কাটানো, শিবনাথ নামের দিশেহারা এক প্রাক্তন বিপ্লবীর চোখ দিয়েই ছবিটিতে আমরা দেখতে পাই যে স্বাধীনতার জন্য শিবনাথরা লড়েছিলেন, সেই স্বাধীনতা লাভের পরে দেশের অবস্থা। দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে যেসব প্রতিশ্রুতি জড়িয়ে ছিল তার সঙ্গে বাস্তবের ফারাক এতটাই বেশি ছিল যে শিবনাথ সেই স্বাধীনতাকে প্রত্যাখ্যান করে। এই ছবি যেমন স্বাধীনতা-উত্তর কালে ভারতের অবস্থার সরাসরি সমালোচনা করেছে, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি সত্যজিৎ রায়ের ছায়াছবি ঘরে বাইরে (১৯৮৪), স্বাধীনতার আগের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ভিতরকার সমস্যার দিকে আঙুল তুলেছিল।  

 ঘরে বাইরে উদারমনস্ক নিখিলেশের স্ত্রী বিমলার বিল্পবী সন্দীপের প্রতি আকর্ষণের কাহিনীকে চিত্রায়িত করেছে। এই ছবির ঘটনাবলী বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সময়কার।

এগারো (২০১১) ছবির পোস্টার। 

ছবিটি এগোনোর সঙ্গে সঙ্গেই বিমলা বুঝতে পারে যে সন্দীপের মুখে বলা আদর্শের কথাগুলো আসলে মূল্যহীন এবং তার অসৎ কর্মকাণ্ডের জেরেই নিখিলেশ শেষমেশ প্রাণ হারায়। এর আগে অবধি চলচ্চিত্রে সাধারণত বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড এবং দেশাত্মবোধক গানকে সদর্থক ভাবে ব্যবহার করা হলেও, সত্যজিৎ এগুলির প্রয়োগ ঘটান জাতীয়তাবাদী আদর্শের সত্যতা এবং সততা বিষয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য। সিনেমাটির প্রারম্ভিক দৃশ্যে পর্দা জুড়ে লেলিহান অগ্নিশিখার পটভূমিতে শোনা যায় বন্দে মাতরম ধ্বনি যা বিদেশি পণ্য জ্বালানোর বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের ইঙ্গিত দেয়। অপর দিকে বিধ্বংসী আগুন দর্শকের দৃষ্টিপথকে দেয় ঢেকে। এ ভাবেই জাতীয়তাবাদের  স্লোগান যে অনেক ক্ষেত্রে অনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয় সেটা দর্শকদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়। ঘরে বাইরে সিনেমাটিতে বিমলার প্রথমবার সন্দীপকে দেখতে পাওয়ার দৃশ্যে আইকনিসিটির শক্তি প্রকট হয়। নিজের বাড়ির রেলিং দিয়ে উঁকি মেরে বিমলা যখন বাইরে তাকায় সেই দৃশ্যপটের মাঝখানে বিপ্লবী সহকর্মীদের কাঁধে চেপে সন্দীপকে মনে হয় যেন ঈশ্বরতুল্য কেউ একজন। সিনেমাটোগ্রাফিতে ব্যবহৃত জুমিং এফেক্ট প্রয়োগে সন্দীপের উত্তেজক কথাবার্তায় বিমলার তার দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ার ঘটনা সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।


পরে সন্দীপ "বিধির 
বাঁধন কাটবে তুমি" গানটি গাইবার সময় বিমলা যেমন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, তেমনি এই দৃশ্যে ক্যামেরার নিরচ্ছিন্ন গতিময়তা দর্শকদেরও অভিভূত করে। অথচ, নিজের জাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য গ্রামের মানুষদের কেন্দ্র করে ঘৃণ্য চক্রান্ত রচনার পরে যখন সন্দীপ "চল রে চল সবে ভারত সন্তান" গানটি গায়, তখন তেজোদ্দীপক গানটিও কিন্তু দর্শকদের ততটা উত্তেজিত করে না এবং ক্যামেরাও আগের মতো আর গতিশীল হয়ে ওঠে না। ছবিটির শেষাংশে সন্দীপকে দেখা যায় ধর্মগ্রন্থ গীতার শ্লোক উদ্ধৃত করে, নিজ স্বার্থে তার ত্রুটিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে। হিন্দুত্বের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের এই সূক্ষ্ম যোগসাজ এভাবেই ধরিয়ে দেন সত্যজিৎ।  

 

স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একই রকম স্বপ্নভঙ্গের উপাখ্যান  দেখানো হয়েছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবি তাহাদের কথায় (১৯৯২)। আট বছর বাদে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া, তিন বছর পাগলাগারদে কাটানো, শিবনাথ নামের দিশেহারা এক প্রাক্তন বিপ্লবীর চোখ দিয়েই ছবিটিতে আমরা দেখতে পাই যে স্বাধীনতার জন্য শিবনাথরা লড়েছিলেন, সেই স্বাধীনতা লাভের পরে দেশের অবস্থা।  

নবরূপে বন্দেমাতরম: বৈকল্পিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা সংগ্রামের নজির অনুসন্ধান (২০১০- বর্তমান)


২০০০- এর দশকের বেশ কিছু বছর যাবৎ হিন্দি 
ছবি ইন্ডাস্ট্রিতে সংগ্রামীদের জীবনীধর্মী ছবি যেমন দ্য লিজেন্ড অফ ভগৎ সিং (২০০২), নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস: ফরগটেন হিরো (২০০৫), এবং মঙ্গল পান্ডে: রাইজিং (২০০৫) বানানো হচ্ছিল। তবে, লগান: ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন ইন্ডিয়া (২০০১) এবং রং দে বাসন্তী (২০০৬) এই দুটি ছবি ভারতীয় চলচ্চিত্রে স্বাধীনতা সংগ্রামকে রূপায়িত করার ধারায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। এর মধ্যে উল্লিখিত দ্বিতীয় ছবিটির কাহিনী কিছুটা আত্মসমীক্ষামূলক হলেও প্রথমটি অপেক্ষাকৃত সরলরৈখিক ভঙ্গিতে, দেশব্যাপী বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে অনেক স্বল্প পরিসরে, ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে সাধারণ ভারতীয়দের ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর গল্প বলে। এক্ষেত্রে সিনেমার গল্পের মূল বিষয়বস্তুতে আসা পরিবর্তন এবং ঐতিহাসিক গবেষণা ও রচনার মাধ্যমে প্রান্তিক গোষ্ঠীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধকে দেখবার প্রয়াসের অদ্ভুত এক সমাপতন লক্ষণীয়। হিন্দির দেখাদেখি, বাংলা সিনেমাতেও একই রকম বদল আসে যা দেখা যায় বাঙালির প্রিয় খেলা ফুটবলকে কেন্দ্র করে তৈরি দুটি সিনেমাতে, এগারো (২০১১) এবং গোলন্দাজ (২০২১)।
 

গোলন্দাজ (২০২১) ছবিতে ঘর্মাক্ত ফুটবলার। 

অরুণ রায় পরিচালিত এগারো ১৯১১ সালে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে খেলে মোহনবাগান ক্লাবের জয়ের কাহিনী জানায়। ফুটবলের ময়দানে দেশীয় খেলোয়াড়দের লড়াই হয়ে ওঠে ঔপনিবেশিকতা বিরোধী সংগ্রামের সমার্থক। ছবিটির গোড়াতেই সাধারণ এক জনবসতির প্রেক্ষাপটে ভেসে আসে আর্তনাদ। বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্রিটিশ পুলিশ তরুণ বিপ্লবীদের ধরপাকড় করবার সময় তাদের ও তাদের পরিবারের ওপর যে অমানবিক অত্যাচার চালাত, এই প্রথম দৃশ্যটি তারই সাক্ষ্য দান করে। যখন এরপরে পর্দায় খেলোয়াড়দের ফুটবল ময়দানে খেলতে দেখা যায় তখনও ক্রীড়াভাষ্য বা সমর্থকদের উল্লসিত জয়ধ্বনির বদলে সেই একই কাতর আর্তনাদ শোনা যায় আর এভাবেই ক্রীড়াজগতের সঙ্গে রাজনীতির যোগাযোগকে তুলে ধরা হয় ছবিটিতে। প্রাথমিক ভাবে যদিও জঙ্গলের মধ্যে বসে বৈপ্লবিক পরিকল্পনা রচনায় ব্যস্ত বিপ্লবীরা এমনকি রাজনৈতিক খবরাখবর জানানোর মাধ্যম সংবাদপত্রগুলিও খেলাকে তুচ্ছ মনে করে, সাধারণ মানুষ কিন্তু সহজেই বুঝতে পেরে যায় যে একমাত্র খেলার মাঠেই ব্রিটিশদের শারীরিক শক্তিতে হারানো সম্ভব।

  

সিনেমাটির অন্যতম নান্দনিক বৈশিষ্ট্য হল ক্যামেরার মাধ্যমে ফাইনাল ম্যাচ চলাকালীন খেলোয়াড়দের চেয়েও বেশি  সমবেত দর্শকদের শারীরিক অভিব্যক্তির প্রদর্শন যা ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাধারণ মানুষদের যোগদানেরই এক প্রতিরূপ। 

হিন্দির দেখাদেখি, বাংলা সিনেমাতেও একইরকম বদল আসে যা দেখা যায় বাঙালির প্রিয় খেলা ফুটবলকে কেন্দ্র করে তৈরি দুটি সিনেমাতে, এগারো (২০১১) এবং গোলন্দাজ (২০২১)।
 

১৮৯০ এর দশকের পটভূমিতে, মোহনবাগানের ক্যাপ্টেন নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারীর জীবনকে কেন্দ্র করে নির্মিত ধ্রুব ব্যানার্জীর ছবি গোলন্দাজে ক্রীড়াজগতের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির গভীর যোগসূত্রের কথা আরো বিস্তারিত রূপে দেখানো হয়েছে। ব্রিটিশ খেলোয়াড়দের সচেতনতামূলক আক্রমণ দ্বারা ভারতীয় খেলোয়াড়দের আহত হওয়ার সঙ্গে আটক করা বিপ্লবীদের ওপরে করা অমানুষিক অত্যাচারের সাদৃশ্য স্পষ্ট। আবার, একাধিক দৃশ্যে খেলার মাঠে খেলোয়াড়দের জায়গা বদলের কৌশলপূর্ণ রূপায়ণ মনে করিয়ে দেয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ঘিরে তৈরি আগেকার ছবি গুলিতে সংগ্রামীদের আক্রমণের ছক কষার দৃশ্য। বিপ্লবীদের যেমন তাদের কাজকর্ম চালানোর জন্য জঙ্গলের মতো নিভৃত আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়, ফুটবল  প্র্যাকটিসের জন্য ঠিক তেমনি খেলোয়াড়দের দরকার হয় একটা মাঠের; বিপ্লবীদের মতই ব্রিটিশ খেলোয়াড়দের সঙ্গে লড়ে জেতার জন্য বাঙালি ফুটবলারদেরও দেখা যায় ঘাম, রক্ত, অশ্রু  বিসর্জন দিতে।

     

জাতীয়তাবাদের সঙ্গে খেলার সম্পর্ক স্থাপনের জন্য একটি দৃশ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাসমূহের বিবরণে সমৃদ্ধ খবরের কাগজগুলির মধ্যবর্তী অংশে ফুটবল ম্যাচের দৃশ্য দেখানো হয়েছে। আবার ফাইনাল ম্যাচের দিন মাঠে খেলোয়াড়রা গেয়ে ওঠেন "বন্দে মাতরম"। এগারোর মতো, গোলন্দাজেও বিপ্লবীদের সশরীরে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়, বিশেষত নগেন্দ্রর বন্ধু ভার্গবের চরিত্রটির মাধ্যমে। ব্রিটিশদের দৃষ্টি এড়াতে, সাধু, পাঠান, পার্শি - এমন বিভিন্ন বেশভূষায় ভার্গবকে দেখতে পাওয়া যায় যা আমাদের সব্যসাচীর (১৯৭৭) কথা মনে করিয়ে দেয়। গোটা ছবি জুড়ে বারংবার ভার্গবকে দেখা যায় নগেন্দ্রকে উৎসাহ দিতে কিন্তু ফিল্মের মাঝামাঝি অংশে এসে যখন জানা যায় যে নগেন্দ্রর গল্পের সূত্রধর স্বয়ং ভার্গব তখন ফুটবল খেলার মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার লড়াইটি চালানোর বিষয়টা যেন আরো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এভাবেই, খেলার সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সম্পর্কটি এগারো সিনেমাটিতে শুধুমাত্র দেখা যায় এবং গোলন্দাজে সেটি শ্রুতিমাধ্যমেও প্রকাশ পায়। স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভ এবং ফুটবলের ময়দানে জয়লাভ যে সমগোত্রীয় সেটা আবারও পর্দায় ফুটে ওঠে যখন নগেন্দ্রর দলটি খেলায় জেতার পরের দৃশ্যেই ভার্গবকে প্রথমবার কোন ছদ্মবেশ ছাড়াই তার বিপ্লবী দলের সঙ্গে ব্রিটিশদের আক্রমণ করতে দেখা যায়।

   

বাংলা সিনেমার পর্দায় দৃশ্যায়িত স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনাবলী দর্শকদের মনকে অবশ্যই গভীরভাবে প্রভাবিত করত। এর প্রমাণ পাওয়া যায় একটি বহুজনবিদিত   ঘটনার মাধ্যমে। অভিনেতা বিকাশ রায় সিনেমার পর্দায় এক নৃশংস ব্রিটিশ মিলিটারি অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় করে জনতার মনে এতটাই ঘৃণার উদ্রেক করতে সফল হয়েছিলেন যে বাস্তবেও ক্ষুব্ধ দর্শকেরা তার দিকে পাথর ও জুতো ছুঁড়ে মেরেছিল। বিকাশ অবশ্য দর্শকদের এই প্রতিক্রিয়াকে প্রশংসা রূপেই গ্রহণ করেছিলেন। সুচতুর ও হিংস্র ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহসিক প্রতিরোধের রূপায়ণ এক থাকলেও, বিগত পাঁচটি যুগে (আলোচনা অনুযায়ী) বাংলা সিনেমার মূল বিষয়বস্তুতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। তবে, অনেক পার্থক্যের মধ্যেও বন্দেমাতরম ধ্বনিটি কিন্তু সেযুগ থেকে এযুগ অবধি নির্মিত এই ছায়াছবিগুলিকে একসূত্রেই বেঁধে রেখেছে।

                                                                                                                                 (শেষ)

লেখক পরিচিতি

স্রগ্ধরামালিনী দাস কলকাতার মেয়ে, স্বাধীন গবেষক। ২০২২ সালে চিত্রসমালোচনার জন্য পেয়েছেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত স্মৃতি পুরস্কার। মনিপাল সেন্টার অফ হিউম্যানিটিজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর। উনিশ এবং বিশের শতকে মেয়েদের লেখালেখি তাঁর গবেষণার বিষয়। পাশাপাশি নিয়মিত লেখেন ভারতীয় চলচ্চিত্র নিয়ে। তাঁর প্রবন্ধ এর আগে প্রকাশিত হয়েছে দ্য স্টেটসম্যান, ফিল্ম কম্প্যানিয়ন এবং ই-সিনে ইন্ডিয়ায়।