ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম লগ্ন থেকেই বাংলা
ছিল তার পুরোভাগে। বাংলা ছবিতে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনী কতটা, কেমন ভাবে এসেছে? দুই পর্বের
এই প্রবন্ধে আট দশকের বাংলা দেশাত্মবোধক ছবির পরিক্রমা করেছেন স্রগ্ধরামালিনী দাস।
আজ প্রথম পর্ব।
কেন BFA এমন
একটি লেখার কথা ভাবল?
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উদযাপন সমাপ্ত হতে চলেছে।
এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমরা ফিরে দেখতে চেয়েছি বাংলা দেশাত্মবোধক ছবির ধারাটিকে। কী ভাবে আট দশক জুড়ে পর্দায় স্বাধীনতা সংগ্রামের
রূপায়ণে কতটা বদল এসেছে বা আসেনি, সেটা তলিয়ে দেখাও আমরা গুরুত্বপূর্ণ
বলে মনে করেছি। ৯ অগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা দিবসকে স্মরণ করে আমরা এই লেখার
প্রথম পর্ব পেশ করলাম।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'পথের দাবী '(১৯২৬) অবলম্বনে নির্মিত ছায়াছবি সব্যসাচীর (১৯৭৭) শুরুতে কালো পর্দার ওপার থেকে ভেসে আসে বন্দেমাতরম ধ্বনি। পরমুহূর্তেই, ফাঁসির দড়ির প্রেক্ষাপটে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের তালিকা দেখানো শুরু হয়ে যায় এবং তারই সঙ্গে বহুপরিচিত দেশাত্মবোধক গানগুলি যন্ত্রসঙ্গীতে বাজতে থাকে, যেমন দুর্গম গিরি কান্তার মরু, একবার বিদায় দে মা এবং আমি ভয় করব না। ইতিমধ্যে ফাঁসির দড়িটি আকারে বর্ধিত হতে হতে পুরো পর্দা জুড়ে ফেলে এবং শেষ পর্যন্ত প্রাক্-স্বাধীনতা পর্বের ভারতের ফুটে ওঠা মানচিত্রের মধ্যেই মিলিয়ে যায়। এ ভাবেই, ছবির একদম গোড়াতেই দেশাত্মবোধক গান, জয়ধ্বনি, আত্মত্যাগ (প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে ফাঁসির দড়ি যা বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রাণনাশের কারণ) এবং মাতৃভূমির মধ্যে সম্পর্কটা স্থাপিত হয়ে যায়। সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক, এই দুই ক্ষেত্রের যোগসূত্র সব্যসাচী ছবির শেষাংশে স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরা হয়, যখন শিল্পী মনের এক ব্যক্তিকে সরাসরি বিপ্লবী দলে যোগ না দিয়ে তেজোদ্দীপক গান লিখতে বলা হয়, যা কিনা বিপ্লবে অংশগ্রহণেরই সমার্থক। সত্যিই পূর্বে উল্লিখিত গানগুলি, বিশেষত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের "বন্দেমাতরম" (১৯৫০ সালে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত রূপে গৃহীত) বহু দশক যাবৎই বাংলা সিনেমায় ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের (১৮৫৭-১৯৪৭) আবহ সৃষ্টির অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং আজকের ছবিতে সেই সময়ের ঘটনাবলীর দৃশ্যায়নে প্রভূত বদল হয়ে থাকলেও গানগুলি এখনও সমান ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ।
চোপ! ব্রিটিশরা
আছে: প্রাক স্বাধীনতা পর্বে বৈপ্লবিক মনোভাব দূরীকরণের প্রয়াস
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এরিক হবসবম, তাঁর 'দ্য এজ অফ এক্সট্রিমস' গ্রন্থে লিখেছেন, "দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে যত বড় ভৌগোলিক অঞ্চল ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শাসনাধীন হয়েছিল, তেমনটা তার আগে কখনোই হয়নি কিন্তু আগে কখনো সাম্রাজ্যবাদী শাসন কায়েম রাখার ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের আত্মবিশ্বাসেও এতটা চিড় ধরেনি"। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে, শুধুমাত্র বিশ্বের উন্নততর অর্থনৈতিক শক্তি রূপেই যে আমেরিকার উত্থান ঘটেছিল তাই নয়, চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও দেশটি অগ্রণী ভূমিকা নেয়। চলচ্চিত্র বিশারদ প্রিয়া জয়কুমার এই বিষয়ে জানিয়েছেন যে নিজেদের দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের জন্য ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদীরা ১৯২৭ সালে সিনেমাটোগ্রাফ ফিল্মস অ্যাক্ট (অথবা, কোটা অ্যাক্ট) পাস করে যা ভারত সহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বত্র চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়। তবে এতে ভারতবর্ষের সদ্যোজাত চলচ্চিত্র শিল্পের পরিচালকদের উৎসাহিত হবার বিশেষ কোন কারণ ছিল না যেহেতু নতুন আইনে পূর্বের সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট ১৯১৮ দ্বারা ধার্য বিষম কর এবং মিডিয়া সেন্সরশিপের কোন নড়চড় হয়নি। এই আইনটি আসলে দৃশ্যমাধ্যম থেকে ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী মতাদর্শকে সরিয়ে ফেলার জন্য প্রযুক্ত ১৮৭৬ সালের নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনেরই চলচ্চিত্রের ওপর আরোপিত প্রতিরূপ মাত্র। এর ফলস্বরূপ নাট্যকারদের মতোই ভারতবর্ষের নবোদিত চিত্রপরিচালকেরাও জাতীয়তাবাদের প্রসারের জন্য প্রতীকী এবং পৌরাণিক কাহিনীর মাধ্যমকেই বেছে নিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য যে এই কারণেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সমসাময়িক কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রস্তুত ছায়াছবির সংখ্যা ছিল প্রায় নগণ্য। ছবিটা বদলাতে শুরু করে বিশ্বযুদ্ধের পরে। বাংলায় একে একে আসতে থাকে চিত্রপরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় (যিনি পরবর্তীকালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন (১৯৭০) ছবিটি করেন) পরিচালিত সংগ্রাম (১৯৪৬); কিংবা সুধীরবন্ধুর বন্দেমাতরম (১৯৪৬); সমর ঘোষ পরিচালিত দেশের দাবী (১৯৪৭); দিগম্বর চট্টোপাধ্যায় এবং সতীশ দাশগুপ্ত পরিচালিত পথের দাবী (১৯৪৭)। সতীশই পরে চিত্রায়িত করেছিলেন দেবী চৌধুরানী (১৯৪৯) এবং আনন্দমঠ (১৯৫১)। চিত্রসমালোচক অমিতাভ নাগ মনে করেন যে ঔপনিবেশিকতা বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে বাঙালি থাকলেও, স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে দেশাত্মবোধক ছায়াছবি নির্মাণে পিছিয়ে থাকার কারণ শুধুমাত্র সেন্সরশিপ নয়। প্রযোজকদের ব্রিটিশ কর্মনির্বাহকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক নষ্ট না করতে চাওয়াও একটা বড় দিক।
চিত্রপরিচালক নরেশ মিত্র অবশ্য অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯১০ সালে প্রকাশিত উপন্যাস গোরা অবলম্বনে ১৯৩৮ সালে তৈরি করেছিলেন একই নামের একটি ছবি।
চলচ্চিত্র বিশারদ প্রিয়া জয়কুমার জানিয়েছেন যে নিজেদের দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের জন্য ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদীরা ১৯২৭ সালে সিনেমাটোগ্রাফ ফিল্মস অ্যাক্ট (অথবা, কোটা অ্যাক্ট) পাস করেন যা ভারত সহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বত্র চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়। তবে এতে ভারতবর্ষের সদ্যোজাত চলচ্চিত্র শিল্পের পরিচালকদের উৎসাহিত হবার বিশেষ কোন কারণ ছিল না।
গোরা ছবির কিছু সাহসী দৃশ্যে উচুঁ জাতের ভদ্র
বঙ্গসন্তানদের, চাকরি রক্ষার্থে অথবা সামাজিক অবস্থান অক্ষুণ্ণ
রাখার জন্য, আত্মসম্মান
বিসর্জন দিয়ে, ভৃত্যের মতো,
ঔপনিবেশিক প্রভুদের তোষণ করতে দেখা যায়। ছবিটিতে বাঙালি যুবকদের স্বাস্থ্যচর্চার দৃশ্যায়নও রয়েছে বেশ সময় জুড়ে। এই স্বাস্থ্যচর্চার প্রসার
বাংলায় হয়েছিল জাতীয়তাবাদী
গোষ্ঠীগুলির হাত ধরে। এমনকি খোদ রবীন্দ্রনাথের
ভাইঝি সরলা দেবী ১৯০২ সালে একটি স্বাস্থ্যচর্চা কেন্দ্র তৈরি করিয়েছিলেন। ১৮৫৭ সালের
সিপাহী বিদ্রোহ, তর্কসাপেক্ষে যেটিকে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা বলে মনে করা
হয়, চলচ্চিত্রে তার অন্যতম প্রাথমিক চিত্রায়ণ দেখা যায় এই গোরা ছায়াছবিতে। ওই বিদ্রোহের
সময়েই গল্পের নায়কের আইরিশ জন্মদাত্রীর প্রয়াণ ঘটে। রাস্তা দিয়ে সার বেঁধে, মশাল,
লাঠি, কামান নিয়ে সৈন্যরা পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চেপে যাচ্ছে এমন দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে
যুদ্ধের আবহকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ছবিটিতে দেখানো হয়েছে হিন্দুত্ববাদী আদর্শের প্রতি
অন্ধবিশ্বাস থেকে সরে এসে গোরা ক্রমে সামাজিক
ও ধর্মীয় সাম্যবাদ নীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করে।
কারণ সে বুঝতে পারে যে যত মত তত পথের দেশ ভারতবর্ষের জন্য এমন ধর্মই উপযুক্ত। প্রত্যক্ষ
ভাবে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার না হলেও, ছবির শেষে শোনা যায় বন্দেমাতরম গান,
যার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসকদের আরোপিত নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে সমকালীন স্বাধীনতা সংগ্রামের
সঙ্গে ছবিটি একাত্ম হয়ে গিয়েছিল।
অতীতের চিত্রনাট্য: স্বাধীনতা
যুদ্ধের প্রারম্ভিক বছরগুলি ১৯৪০-১৯৬০
১৯৪৭
সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরে বাঙালি চিত্রপরিচালকরাও মুক্তি পেলেন ঔপনিবেশিক নজরদারির
হাত থেকে। নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রে নাগরিকদের কাছে সংঘবদ্ধ সংগ্রামের গৌরক
কাহিনী তুলে ধরার প্রয়োজন এবং চাহিদা তখন তুঙ্গে। তবে যে সব ছায়াছবি এই কাজটি করবার চেষ্টা করল,
তাদের কিছু সমস্যারও মুখোমুখি হতে হল। প্রথমত, ভারতের জাতীয়তাবাদের
ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি আদৌ একই সরলরেখায় এগিয়েছে কি না, সেই বিষয়ে বিস্তর মতপার্থক্য
ছিল। যেহেতু দেশভক্তি সংক্রান্ত মতাদর্শের পরিসর ছিল বিশাল (গান্ধীবাদী,
সশস্ত্র বিপ্লববাদী, ধর্মীয় জাগরণবাদী, সমাজবাদী ইত্যাদি), বিষয়টি নিয়ে মতপার্থক্য ঘটাই ছিল স্বাভাবিক। সমস্যাটির
সমাধান কিছুটা হলেও করা গিয়েছিল প্রথম দিকের ছায়াছবিগুলিতে বিভিন্ন
মতাদর্শ নিয়ে চরিত্রদের কথোপকথন দেখিয়ে, যদিও শেষ পর্যন্ত যে কোন একটি আদর্শকে বেশি
গুরুত্ব দেওয়া হত। দ্বিতীয় সমস্যাটি ছিল প্রযুক্তিগত: স্বাধীনতা সংগ্রাম চিত্রায়ণের
জন্য অতীতকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা কঠিন হয়ে উঠছিল। তা ছাড়া, যুদ্ধের দৃশ্যগুলিকে
বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হলে চিত্রপরিচালকদের
প্রয়োজন ছিল বড় আর্থিক বিনিয়োগ। মিডিয়া স্টাডিজ স্কলার
শৈফত এস. এবং আহমেদ এস. জানিয়েছেন যে নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশী চিত্রপরিচালকরা সিনেমার
মাধ্যমে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ দেখাতে গিয়ে এই একই সমস্যার সম্মুখীন হন। মজার বিষয়
হল এই যে দ্বিতীয় সমস্যাটির সমাধান প্রথমটির সমাধানের পথেই অর্থাৎ যুদ্ধের দৃশ্যের
পরিবর্তে মতভেদ, কথালাপ, ভ্রমণ, আশঙ্কাজনক মুহূর্ত, তর্ক, অত্যাচার, ইত্যাদি প্রদর্শনের
দ্বারাই সম্ভব হয়।
বিভিন্ন
স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ঘিরে তৈরি এই সময়কার বেশির ভাগ ছায়াছবিগুলিতে ইতিহাসের দৃশ্যায়নে নানান পন্থা অবলম্বন করা হত। প্রায়শই আসল জাতীয়তাবাদী নেতাদের
যেমন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, সুভাষ চন্দ্র বসুর ভয়েস বা ভিডিও রেকর্ডিং ব্যবহার করা হত।
আরেকটি বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি ছিল ছায়াছবির
শুরুতে অথবা শেষে, ভারতবর্ষের সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী অথবা ভারতের জাতীয় পতাকার
প্রেক্ষাপটে, একজন সূত্রধরের মাধ্যমে পলাশীর যুদ্ধ, ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ, সিপাহী বিদ্রোহ, বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসির
সাজা ঘোষণার মতো বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার কথা দর্শকদের জানানো। ছবিটির শুরুতেই জাতীয় পতাকার গরিমা বর্ণনা
করা হলে পরবর্তী অংশে ব্রিটিশ অফিসারদের দ্বারা জাতীয় পতাকার অবমাননার মতো দৃশ্য দর্শকদের আরো বেশি উত্তেজিত করে তুলত। তখনকার
সিনেমার আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল চরিত্রদের মুখে আনন্দমঠ (১৮৮২), শিখের বলিদান (১৯২৫), এবং পথের দাবী
(১৯২৬) ইত্যাদি রাজনৈতিক পটভূমিকায় রচিত উপন্যাসের নামোল্লেখ। যদিও এই নিবন্ধে আলোচিত
ছবিগুলির স্থান - কাল - পাত্র সবই বাংলার সঙ্গে সম্পর্কিত, সেখানেও
ভাষার ক্ষেত্রে ইংরাজি
ও হিন্দির ব্যবহার দেখা যায় যা ঔপনিবেশিক বঙ্গে ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের সহাবস্থানের
দিকে ইঙ্গিত করে।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, তর্কসাপেক্ষে যেটিকে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা বলে মনে করা হয়, চলচ্চিত্রে তার অন্যতম প্রাথমিক চিত্রায়ণ দেখা যায় এই গোরা ছায়াছবিতে। ওই বিদ্রোহের সময়েই গল্পের নায়কের আইরিশ জন্মদাত্রীর প্রয়াণ ঘটে।
এই
সময়ের সর্বাপেক্ষা সফল ছবিগুলির একটি হল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৯৪৯)।
নির্মল চৌধুরী পরিচালিত এই ছবিটিতে স্কুলশিক্ষক মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ১৯৩০
সালে চট্টগ্রাম বিদ্রোহের ঘটনাই দেখানো হয়েছে। ছবিটিতে দুটি স্থানকে জাতীয়তাবাদের প্রাণকেন্দ্র
রূপে বেছে নেওয়া হয়েছে, ক্লাসরুম এবং জঙ্গল। ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের জাতীয়তাবাদের
পাঠ দেওয়া হয় আর স্কুল শেষ হবার পরে সেখানেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সূর্য সেনের মতো নেতাদের আলাপ আলোচনা চলে। অন্য দিকে জঙ্গল হল ঔপনিবেশিকতা
বিরোধী বিদ্রোহীদের পালিয়ে গা ঢাকা দেবার ও নতুন আক্রমণের ছক কষবার পীঠস্থল। বিপ্লবীদের
সাহসিকতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার কথা দর্শকদের সামনে তুলে ধরার জন্য জঙ্গলের মতো স্থানকে উপযুক্ত বলে মনে করা হয়েছিল। ছবিটিতে বিপ্লব ও বিবাহের মধ্যে দ্বন্দ্বের
বিষয়টিও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং এটাও স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছে যে বিপ্লবীদের জীবনে
বিপ্লবের গুরুত্বই সর্বাধিক। সূর্য এবং তাঁর স্ত্রী পুষ্পার সম্পর্কের মাধ্যমে বিষয়টি
দেখানো হয়েছে। বিপ্লবী শ্রীঅরবিন্দ নিজের স্ত্রী মৃণালিনীকে চিঠির মাধ্যমে বিপ্লবের
সঙ্গে যুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করতেন। বই হিসেবে
প্রকাশিত তাদের আদানপ্রদান করা চিঠিপত্র নিজের স্ত্রীকে পড়ে শোনান সূর্য। নিজে চিঠি
লিখেও তাকে একই রকম নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু পুষ্পা রাজি হন না। বরং সূর্যর
দীর্ঘকালীন অনুপস্থিতির জেরে একাকীত্বের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে গলায় ফাঁস লাগিয়ে
আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন পুষ্পা। যদিও ব্যর্থ হন। তবে সূর্যের উপস্থিতিতে
পরবর্তী এক দৃশ্যে মারা যান পুষ্পা এবং শেষ সময়ে স্বীকার করেন যে সূর্যের দেওয়া পরামর্শই
সঠিক ছিল। পুষ্পার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে দেখা যায়না সূর্যকে বরং পরবর্তী দৃশ্যেই
দেখানো হয় কংগ্রেসের অধিবেশন চলছে। পারিবারিক দুঃখ কষ্ট থেকে সরিয়ে এনে, দর্শকের
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় দেশের মানুষের যন্ত্রণার দিকে। এ ভাবেই এই ছবিতে সাংসারিক সুখদুঃখের
চেয়ে বিপ্লবের গুরুত্ব যে বেশি, সে কথা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নারীকে সাংসারিক বৃত্তের
অংশ হিসেবে গণ্য করার মানসিকতার কারণেই হয়তো দেখা যায় যে বিপ্লবে নারীর গুরুত্ব সীমিত।
তাই জন্যই সূর্যের মহিলা সহযোদ্ধা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ব্রিটিশ অফিসারদের সঙ্গে লড়বার জন্য রিভলভার চেয়েও প্রত্যাখ্যাত
হন। পরে যদিও সূর্য তাঁকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিশন পরিচালনার দায়িত্ব
দেন, সেই মিশন চলাকালীন প্রীতি আত্মঘাতী হন সায়ানাইড সেবন করে। সিনেমাটির আরেকটি মূল
বৈশিষ্ট্য হল রাজনৈতিক গোলযোগ অথবা সূর্যের মানসিক অস্থিরতা বোঝানোর জন্য একাধিক দৃশ্যের
সুপার ইম্পোজিশন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ছবিতে গানের ব্যবহারও আলাদা করে উল্লেখযোগ্য। গল্পের প্রথমাংশে যখন সূর্যর দলটি অপেক্ষাকৃত
সহিষ্ণু গান্ধীবাদী পন্থায় আন্দোলনের কাজ চালায় সেই সময় "ওদের বাঁধন যতই
শক্ত হবে"র মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছে। আবার ফিল্মের পরবর্তী অংশে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় শোনা
যায়, "কারার ঐ লৌহকপাটের" মতো নজরুলগীতি। শান্তিপূর্ণ এবং বৈপ্লবিক ভাবধারার
সঙ্গে যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে মেলানোর
প্রবণতাই এখানে স্পষ্ট। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ছবিটির শেষ পর্যায়ে, দৃশ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে সূর্যের ফাঁসির ঘটনার
দ্বারা ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের নেপথ্যে বিপ্লবের অবদানের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
ফাঁসির
পূর্বে সূর্যের চরিত্রটি সরাসরি জনতাকে উদ্দেশ করে বলেন
যে,
শুধু বাংলা নয় গোটা
দেশের স্বাধীনতার জন্যই তাঁর এই লড়াই। ফাঁসির দৃশ্যের ঠিক পরেই পরাবাস্তবধর্মী
একটি দৃশ্যে দেখা যায় সূর্যের ছায়াশরীর সমুদ্র পেরিয়ে আকাশে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এবং
এর পরেই
ভারতের উত্থিত জাতীয় পতাকাটি দেখিয়ে ছবিটি
শেষ হয়। শেষের এই দৃশ্যাবলী যেন ভারতের স্বাধীনতা ও সূর্যের আত্মবলিদানকে এক সূত্রে
বেঁধে দেয় এবং ভারতবর্ষের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা
করে।
বঙ্গভূমির একটি ছোট শহরের পটভূমিতে নির্মিত '৪২ ছবিটিতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের তুলনায় নারীদের অধিকতর স্বাধীন ভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিতে দেখা যায়। অবশ্য তার একটা বড় কারণ এই ছবিটিতে বিপ্লবীরা গান্ধীবাদী, যিনি ভারতের নারীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
১৯৪২ সালের
ভারত ছাড়ো আন্দোলন ঘিরে তৈরি পরিচালক হেমেন গুপ্ত'র ‘৪২ (১৯৫১) এই যুগের আরেকটি উল্লেখযোগ্য
ছবি। হেমেন নিজেও ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, তিনি পরে হিন্দিতে
আনন্দমঠ (১৯৫২) ছবি করেছিলেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সিনেমায়
দৃশ্যায়নের যে সব
পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল সেগুলোই আরো পরিস্ফুট হয়ে ধরা দিয়েছে ‘৪২ ছবিতে,
যেমন বিপ্লবীদের সঙ্গে সিপাহীদের দীর্ঘ সংলাপ বিনিময়। ব্রিটিশ
সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বোঝাতে বারবার জিপগাড়ির যাতায়াত দেখানো হয়েছে যে গাড়িতে চেপে
ঔপনিবেশিকতা বিরোধী বিপ্লবীদের পিছু ধাওয়া
করত সেপাইরা আর ধরতে পারলে অত্যাচার করে পরে কোথাও ছুঁড়ে ফেলে দিত। বঙ্গভূমির একটি ছোট শহরের পটভূমিতে নির্মিত '৪২ ছবিটিতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের তুলনায় নারীদের অধিকতর স্বাধীন ভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিতে দেখা যায়। অবশ্য তার একটা বড় কারণ এই ছবিটিতে বিপ্লবীরা গান্ধীবাদী, যিনি ভারতের নারীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ছবিতে গল্পের নায়ক অজয়ের
ঠাকুমা ও স্ত্রীকে তার পরিকল্পিত আন্দোলনের পন্থা নিয়ে সরাসরি আলোচনা করেন এবং আন্দোলনে অংশ নেন।
তবে মেয়েদের যোগদানের মূল্য দিতে হয়েছিল অনেকটাই। '৪২ ছবিতে তাঁদের পুলিশের দ্বারা ধর্ষিত হতে হয় এবং বন্দুকের গুলিতে লেখা হয় শেষ পরিণতি। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সূর্যের চেয়ে ‘৪২ ছবির নায়ক অজয় তার পরিবারের সঙ্গে মানসিক ভাবে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। তার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড রুখতে এই দুর্বলতাকেই কাজে লাগায় পুলিশ। এমন ঘটনাক্রম আরো একবার সংসার জীবন এবং বিপ্লবের মধ্যেকার অসামঞ্জস্য ও এই দুইয়ের মধ্যে দূরত্ব বজায় না রাখার বিপদজনক পরিণতির কথা প্রকট করে তোলে। ‘৪২ সিনেমাটির সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য জুড়ে আরেকটি বিষয় দেখানো হয়েছে যা হল বিপ্লবীদের পরিকল্পনা ও তাদের ঠিকানা পুলিশের কাছে ফাঁস করার নেপথ্যে বেইমান দেশীয় মানুষদের ভূমিকা। সিনেমাটি যেন সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত ভারতীয় জনগণকে সতর্ক করে দেয় এ রকম স্বদেশী প্রতারকদের থেকে সাবধানে থাকতে। এই ধরণের বিষয় নিয়ে তৈরি অন্যান্য ফিল্মের ধাঁচে, ‘৪২ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাফল্যের কারণ হিসেবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে বিশেষত ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে চিহ্নিত করেছে। সেই সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির "ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়" স্লোগানের উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে না পড়াই নাগরিকদের জন্য মঙ্গলের।
বিয়াল্লিশে অভিনেত্রী মঞ্জু দে'কে দেখা যায় অত্যাচারিত হতে। আবার, তিনিই নীল আকাশের নীচে ছবিটিতে ওয়াংয়ের পাতানো 'বোন' বাসন্তীর ভূমিকায়। ওয়াংয়ের স্মৃতি রোমন্থন তাই যেন গল্পের গণ্ডি পেরিয়ে দুটো ফিল্মের মধ্যে এক যোগসূত্র টেনে দিয়েছে।
মহাদেবী
ভার্মার লেখা 'চিনি ফেরিওয়ালা' গল্প অবলম্বনে নির্মিত নীল আকাশের নীচে (১৯৫৯) ছবিটিতে ১৯৩০ এর দশকের কলকাতার পটভূমিতে কাপড় ফেরিওয়ালা ওয়াং লু 'র কাহিনী জানা
যায়। স্বামীর অমত সত্ত্বেও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, বাঙালিনী বাসন্তীর সংস্পর্শে এসে
ওয়াং ১৯৩১ এর জাপানি আক্রমণে বিধ্বস্ত স্বদেশ চীনের জন্য কাজ করার অনুপ্রেরণা পায়।
ভারত ও চীনের মধ্যে সহযোদ্ধাদের মতো
বোঝাপড়ার ধারণাটি সিনেমায় স্পষ্ট হয় যখন
ওয়াং প্রথমবার তার ফেরির জিনিস বাসন্তীকে বিক্রি করতে আসে। বাসন্তী যখন তাকে বলে যে
সে বিদেশি পণ্য ব্যবহার করে না, ওয়াং নিজের চোখমুখ, গায়ের রঙের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে "হাম নো
ফোহ - এন, হাম চিনাম্যান '। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী বাসন্তী এবং চৈনিক দেশপ্রেমী ওয়াংয়ের
মধ্যের সম্পর্কটা তাদের কথা অনুযায়ী শুধুই ভাই-বোনের ছিল তা নয়, বরং সেই সম্পর্ক
সমব্যথীর। সামাজিক ও রাজনৈতিক অবদমন তাদের দু'জনের মধ্যে সহমর্মিতার সেতু বেঁধে দিয়েছিল।
বিয়াল্লিশ ছায়াছবিতে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে
যুক্ত থাকায় নারীর সম্মান লুণ্ঠিত হয়েছিল আর নীল আকাশের নীচেয় বাসন্তীকে দেখে ওয়াংয়ের মনে পড়ে
যায় এক চিনা জমিদারের তার নিজের বোনকে ধর্ষণ করার স্মৃতি। বিয়াল্লিশে অভিনেত্রী মঞ্জু
দে ' কে দেখা যায় অত্যাচারিত হতে। আবার, তিনিই নীল আকাশের নিচে ছবিটিতে ওয়াংয়ের
পাতানো 'বোন' বাসন্তীর ভূমিকায়। ওয়াংয়ের স্মৃতি রোমন্থন তাই যেন গল্পের গণ্ডি পেরিয়ে
দুটো ফিল্মের মধ্যে এক যোগসূত্র টেনে দিয়েছে।