নিবন্ধ

প্রথম পাতা > নিবন্ধ
মোহনবাগানের মেয়ে ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা
ফুটবল ও বাংলার সিনেমার আলাপ, জোড় ও ঝালা
তারিখ : 01-January-1970

কেন মুম্বইয়ে মোহনবাগান- ইস্টবেঙ্গল খেলার দিনে এস ডি বর্মন এবং মান্না দে’র সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের গান রেকর্ডিং বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? সপ্তপদী সিনেমায় ফুটবল মাঠে ড্রিবলিংয়ের কাজটা উত্তম কুমারের হয়ে কে করেছিলেন ? ১৯৩২ সালে কোন নির্বাক ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ভারতীয় ফুটবলের চৈনিক প্রাচীর গোষ্ঠ পাল?

'মোহনবাগানের মেয়ে’ আর ‘ইস্টবেঙ্গলের ছেলে'দের খেলার স্কোর গুনতে গুনতেই মাঠের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছেন রূপায়ণ ভট্টাচার্য, ময়দানের উন্মত্ততার একটা তাজা অনুভব দর্শকদের পাইয়ে দিতে। 

বিএফএ এই কাজটার দায়িত্ব নিল কেন: 

যদিও বাংলার ফুটবলের সেই অতীত গরিমা আজ অস্তমিত, দেশের এই অঞ্চলে ফুটবল নিয়ে মানুষের আগ্রহে কিন্তু ভাটা পড়েনি। এই কারণেই আমাদের সময়ের এক শ্রদ্ধেয় ক্রীড়া সাংবাদিককে অনুরোধ করেছিলাম ফুটবলের সঙ্গে রুপোলি পর্দার সম্পর্কের ইতিহাসটি নথিবদ্ধ করে রাখতে। এই প্রথম আমরা এমন একটা বিশ্লেষণী লেখা পেলাম যা একই সঙ্গে গ্যালারির কাহিনীতে সমৃদ্ধ।

আকাশবাণী ভবন থেকে সামান্য দূরে, ময়দানে এক মূর্তির নীচে বসে চিনাবাদাম খাচ্ছিলেন বাঙালির এক চিরপরিচিত ছবির নায়ক প্রদীপ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর বন্ধু গৌতম চক্রবর্তী। চাকরির ইন্টারভিউয়ের নানা প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা চলছে।

রামায়ণের রামের বোনের নাম কী জাতীয়। তখনই দূরের মাঠে গর্জন। এক মিনিটের জন্য সিনেমায় দেখা গেল, মোহনবাগান মাঠের দুটাকার গ্যালারিতে উৎসব। লোকে নাচছে গ্যালারিতে। প্রদীপের বন্ধু আনমনে বললে, ‘লাস্ট মিনিটে ঠুকল শালা মোহনবাগান। 

খেলা ভেঙেছে মোহনবাগান মাঠে। বন্যার মতো মাঠ থেকে মানুষ বেরোচ্ছে। একজনকে দেখে প্রশ্ন করল গৌতম। সে একটু বেশি চনমনে।

 -ও দাদা, এই যে, ও দাদা, কী হল দাদা?

-থ্রি টু ওয়ান।

-কে জিতল?

-মোহনবাগান

-আ-হা-হা। থ্যাঙ্ক ইউ।

তারপর দুই বন্ধু পাশ দিয়ে যাওয়া মাঠ ফেরত মানুষগুলোর চেহারা দেখে অনুমান করতে থাকে, কে কোন পেশার। কারা বেকার। কে কেরানি। কে অবসরের মুখে দাঁড়ানো কেরানি। কে গ্র্যাজুয়েট।

গ্র্যাজুয়েট ভাবা লোকটিকে অকস্মাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হল। প্রদীপ পরীক্ষায় অনার্স পাননি কদিন আগে, সম্ভবত, ওই জন্য এই প্রশ্ন।

আপনি পাস না অনার্স দাদা?

উত্তর এল: মোহনবাগান

পাল্টা উত্তর: থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

এই যে আপনি পাস না অনার্সের প্রশ্নে উত্তর আসে মোহনবাগান, তখনই যেন বাংলা সিনেমার সঙ্গে ফুটবলের সম্পর্ক আরও জমাট হয়ে যায়।

কার ছবি এটা?

সত্যজিৎ রায়।

কী ছবি?

কাল্ট ছবি— 'জন অরণ্য'।

ফুটবল এই ভাবে একটা সময় বারবার ঘুরে ফিরেছে বাংলার ছবির হৃদকমলে, জলসাঘরে। প্রেমের মতো—কখনও হাসিয়েছে, কখনও কাঁদিয়েছে। কেঁদেও যেমন মানুষ ভালোবেসেছে ফুটবলকে। জন অরণ্য ছবিতে যে ভাবে উঁকি দিয়েছে কলকাতা ফুটবল, তাতে স্পষ্ট বোঝা যায়, ১৯৭৫ সালে বাঙালি কতখানি আবেগতাড়িত ছিল ফুটবল নিয়ে।

ধন্যি মেয়ে ছবির সেই গান, সব খেলার সেরা, কে ভুলতে পারে?

বাংলা সিনেমায় ফুটবল নিয়ে সবচেয়ে স্মরণীয় দৃশ্যটা কী?

এক মিনিটের ভিতরে বলতে হবে।

বাজি রেখে বলতে রাজি আছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবির তিন-চারটি দৃশ্যের কথা উঠবে সবার আগে।

কোথাও উত্তমকুমার নিজের বাড়িতে গোষ্ঠ পালের মূর্তিতে প্রণাম করতে করতে ম্যাচে জয়ের জন্য প্রার্থনা করছেন। রাতের স্বপ্নে ফুটবল ম্যাচ দেখতে দেখতে গোল করার ভাবনায় লাথি মেরে বিছানা থেকে ফেলে দিয়েছেন স্ত্রী সাবিত্রীকে।

গ্রামের জমিদার জহর রায় মাঠের মধ্যে রেফারি হয়ে মাঠে নামা গ্রাম্য পুরোহিত রবি ঘোষকে নির্দেশ দিচ্ছেন পেনাল্টি দেওয়ার মতো। রেফারি তিড়িং তিড়িং লাফাচ্ছেন।

তপেন চট্টোপাধ্যায়, কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়রা ছোট ট্রেনের কম্পার্ট্মেন্টের মধ্যে ফুটবল লুফতে লুফতে লিপ দিচ্ছেন মান্না দে-র গানে, ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল।’ ফুটবল নিয়ে কাল্ট গান বাঙালির।

সুখেন দাস গাছের ওপর বসে মাইক হাতে ধারাবিবরণী দিচ্ছেন গলার শিরা ফুলিয়ে।

অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ১৯৭১ সালের ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবি যে ফুটবল নিয়ে বাংলায় জনপ্রিয়তম মাইলফলক, তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠবে না। সিনেমাটা অধিকাংশ বাঙালির এত প্রাণের যে, ছবিটা মাত্র একবার দেখা মানুষ পাওয়াই খুব কঠিন এই বাংলায়। অবশ্যই ফুটবল নিয়ে বাংলায় সেরা ছবি এটাই।

তবে ফুটবলকে কেন্দ্র করে সেরা দৃশ্যের কথা উঠলে ‘ওরা থাকে ওধারে’ ছবিতে দুটি দৃশ্যকে ভুলব না। সিনেমাটা ১৯৫৪ সালের। পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত। তাঁর হাত থেকে অভয়ের বিয়ে, সদানন্দের মেলা, সাথীহারা, হাত বাড়ালে বন্ধু, সাত নম্বর কয়েদির মতো সুপারহিট সিনেমা হয়েছে। মোট ১৮টি ছবির পরিচালক। উত্তম-সুচিত্রার উত্থানের পিছনে সুকুমারবাবুর বড় অবদান।

'ওরা থাকে ওধারে' ছবিতে উত্তমের নাম চঞ্চল, সে উত্তর কলকাতার ঘটি। সুচিত্রা আবার বাঙাল পরিবারের মেয়ে।

এখনকার প্রজন্ম কল্পনা করতে পারবে না, রেডিওতে ফুটবল ম্যাচের ধারাবিবরণী শোনার উত্তেজনা। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে কী ভাবে একটা রেডিওর ধারেকাছে কতজন বসে থাকতেন ম্যাচের উত্তেজনায় নিজেদের সেঁকে নেওয়ার জন্য।

এ ছবিতে রেডিওর পাশে ও ভাবেই উত্তেজিত হয়ে সংলাপ ছুঁড়ছিলেন ছবি বিশ্বাস এবং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। বাস্তবে ছবি বিশ্বাস মোহনবাগান ভক্ত, ভানু ইস্টবেঙ্গলের। সিনেমাতেও ছিলেন তাই। তাঁদের মুখের অভিব্যক্তি, উচ্ছ্বাস, বিদ্রুপ তাই সাধারণ সমর্থকদের সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। চোখে লেগে থাকে। ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে তাঁদের তর্কও যেমন মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। ১৯৫৪ সালের এ ছবিতে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের ইলিশ খাওয়া নিয়েও একটি দৃশ্য রয়েছে। ইস্টবেঙ্গল অন্ত প্রাণ বাঙাল ভানু সেখানে বলছেন তুলসী চক্রবর্তীকে, ইলিশ তুলে কথা বলা চলবে না!

ইস্টবেঙ্গল মাঠে গ্যালারিতে নিয়মিত দেখা যেত ভানুকে। অনেকের কাছে শোনা, স্টার ভ্যালুকে গুরুত্ব না দিয়ে এক এক দিন গেটও সামলাতেন তিনি। মোহনবাগান মাঠে থাকতেন গায়ক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আগে জনপ্রিয়তম বাঙালি গায়ক। তিনি খেলা দেখে হাঁটতে হাঁটতে ফিরতেন কলেজ স্ট্রিটের বাড়ি। একবার গ্যালারিতে এক সমর্থক চুনী গোস্বামীকে গালাগাল করছিলেন ভালো খেলতে না পারায়। ধনঞ্জয় ক্রুদ্ধ হয়ে সে সমর্থকের সদস্য কার্ড কাড়ার দরবার করেছিলেন।

এই দৃশ্যের পাশাপাশি ছিল উত্তম-সুচিত্রাকে ঘিরে ছিল দুই কিশোর-কিশোরীর সংলাপ। যে প্রশ্ন বাঙালির সবার। তুমি ইস্টবেঙ্গল, না মোহনবাগান? মৃদু হেসে সুচিত্রা বলেছিলেন, ‘আমি যে জিতবে, তার সাপোর্টার।’ কিশোর ইস্টবেঙ্গলের ভক্ত। কিশোরী মোহনবাগানের। তাদের ঝগড়া মেটাতে যখন সুচিত্রা সমস্যায়, তখন সেখানে হাজির উত্তম। সেই প্রশ্নটা তাঁকেও শুনতে হল বাচ্চাদের কাছে। তুমি কাদের? উত্তম প্রথমে জানতে চাইলেন সুচিত্রা কাদের সমর্থক। বাচ্চাদের কাছে সুচিত্রার উত্তর শুনে মহানায়ক বলে উঠলেন, ‘আমি তা হলে যে হারবে, সেই দলের সমর্থক।’ বাচ্চারা চলে গেলে উত্তমের সংলাপ সুচিত্রাকে, ‘আজ আকাশের অবস্থা ভালো নয়।’ সুচিত্রা বললেন, কেন? উত্তমের উত্তর, ‘কেন আবার? আজ যে ওই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল’।

একটা সময় যখন বাংলার ফুটবল বাঙালি সমাজের একেবারে হৃদয়ের লাব-ডুব শোনাত, সে সময় সিনেমা ও গানের অধিকাংশ তারকা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে আচ্ছন্ন থাকতেন। মাঠে গেলে তাঁদের দেখা পাওয়াটা ছিল বাধ্যতামূলক ব্যাপার। আশির দশকের শেষ দিকেও সুব্রত ভট্টাচার্যের সঙ্গে সঙ্গে মোহনবাগান তাঁবুতে দেখা যেত বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়কে। পরের দিকে চিন্ময় রায়কে। সুব্রতই বেশি জনপ্রিয়। ওঁরা তাঁর আলোয় আলোকিত।

ইস্টবেঙ্গল মাঠে গ্যালারিতে নিয়মিত দেখা যেত ভানুকে। অনেকের কাছে শোনা, স্টার ভ্যালুকে গুরুত্ব না দিয়ে এক এক দিন গেটও সামলাতেন তিনি। মোহনবাগান মাঠে থাকতেন গায়ক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আগে জনপ্রিয়তম বাঙালি গায়ক। তিনি খেলা দেখে হাঁটতে হাঁটতে ফিরতেন কলেজ স্ট্রিটের বাড়ি। একবার গ্যালারিতে এক সমর্থক চুনী গোস্বামীকে গালাগাল করছিলেন ভালো খেলতে না পারায়। ধনঞ্জয় ক্রুদ্ধ হয়ে সে সমর্থকের সদস্য কার্ড কাড়ার দরবার করেছিলেন। চুনীর খুব ভক্ত ছিলেন ধনঞ্জয়। ড্রেসিং রুমে তাঁর ছিল অবাধ যাতায়াত। অনেক সময় ম্যাচের আগে ফুটবলাররা ধনঞ্জয়ের কাছে গান শুনতে চাইতেন ক্লাব তাঁবুতে। সে গান শুনলে নাকি বাড়তি অনুপ্রেরণা পাওয়া যাবে।

তারকাদের মধ্যে একেবারে ক্লাব কর্তা হয়ে বসেছিলেন উত্তমের আগের আমলের সুপারস্টার জহর গঙ্গোপাধ্যায়। মোহনবাগানের হকি সচিব ছিলেন অনেক দিন। তখন আভিজাত্য ছিল সে পদের। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের দুই ক্লাবের মাঠ এজমালি। জহর গঙ্গোপাধ্যায় সে সময় স্টার থিয়েটারে উত্তম-সাবিত্রীর বিখ্যাত শ্যামলী নাটক করতেন নিয়মিত। সপ্তাহে শনি-রবিবার বাদে সব দিন এসে আড্ডা মারতেন মোহনবাগানের লনে (এখন এরিয়ান তাঁবু)।

সপ্তপদীর ফুটবল মাঠেও ত্রাতা উত্তম কুমার।

মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল টানাপোড়েন হাজির হয়েছিল বাঙালির বহু আলোচিত ছবি সপ্তপদীতে। ১৯৬১ সালের ছবি। পরিচালক অজয় কর সেখানে দেখাচ্ছেন একটি ফুটবল ম্যাচ। তখন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের এজমালি মাঠ। বসুশ্রী সিনেমার মালিক মন্টু বসু আবার ইস্টবেঙ্গল কর্তা। তাঁর ব্যবস্থাপনাতেই ছবিতে ইস্টবেঙ্গল টিম খেলেছিল। মন্টুবাবু ছিলেন ইস্টবেঙ্গল কর্তা জ্যোতিষ গুহের ডান হাত। তাঁর সিনেমা হলেই থাকতেন ইস্টবেঙ্গলের সুপারস্টার আমেদ খান। আমেদের ছিল তাসের নেশা। সেখানে তিনি তাস খেলতেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শ্যামল মিত্রদের সঙ্গে। তাঁকে খেলার দিনও তাসের আসর থেকে ওঠানো ছিল কঠিন। মন্টুবাবু কোনও মতে ওঠাতেন। এবং ওই সূত্রে ভানুও মাঠে যেতেন আমেদের সঙ্গে গাড়িতে। ভানুর প্রিয় যেমন ছিলেন আমেদ খান, উত্তম কুমারের তেমন চুনী গোস্বামী। ভাই তরুণ কুমারকে উনি এমনও প্রশ্ন করতেন, ‘কে বেশি জনপ্রিয়? আমি না চুনী?’

ময়দানে এখানেই একটা প্রচলিত গল্প রয়েছে। সপ্তপদী ছবিতে উত্তমকে পরতে হচ্ছিল ইস্টবেঙ্গলের জার্সি। মোহনবাগান ভক্ত উত্তম তা পরতে অস্বীকার করেন। সাদা কালো ছবি, সেখানে জার্সির রং লাল হলুদ, না সবুজ মেরুন বোঝা যাবে না। তবু অটল উত্তম। শেষ পর্যন্ত সুচিত্রার কথায় রাজি হলেন। ইস্টবেঙ্গল ভক্তরা বলেন, সুচিত্রা ছিলেন তাঁদের ‘লোক’। সে ছবিতে জলকাদা মাঠে উত্তমকে ড্রিবলিং করতে হয়েছিল। এখনও উত্তমের সেই ড্রিবলিং নিয়ে ফুটবল মহলে অনেক আলোচনা হয়। অনেকে বলেন, সেই ড্রিবলিংগুলো আসলে ছিল তুলসীদাস বলরামের। অনেকে বলেন চুনী গোস্বামীর।

চুনী যে নন, এটা স্পষ্ট। কেননা ওই সময় মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের এজমালি মাঠ। মোহনবাগান সেই সময় খেলতে গিয়েছিল পূর্ব আফ্রিকায়। ক্লাবে কেউ ছিল না। উত্তম যে মোহনবাগানের জার্সি চেয়ে পাননি, তার কারণও এটাই। তখন ক্লাবে এত জার্সিও থাকত না। আর মন্টু বসু ইস্টবেঙ্গল কর্তা বলে ম্যাচে যে ইস্টবেঙ্গলের প্রাধান্য থাকবে, এ তো নতুন করে লেখার দরকার নেই।

'সপ্তপদী'র সেই বিখ্যাত শুটিংয়ের দিন মাঠে হাজির ছিলেন বিখ্যাত ফুটবলার সুকুমার সমাজপতি। তিনি তখন মোহনবাগানে। চোট বলে আফ্রিকা যেতে পারেননি। সুকুমার অবশ্য মনে করেন, ওই ড্রিবল চুনী বা বলরামের কারও নয়। দিনটা স্পষ্ট মনে আছে তাঁর। ‘আমার তখন চোট। কামব্যাক করার চেষ্টা করছি। ভারী বল নিয়ে ট্রেনিং করছি। মাঠে গিয়ে দেখি প্রচণ্ড ভিড়। মালি ভাসিয়াকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, উত্তম-সুচিত্রা দুজনেই আছে। আমি ভারী বল নিয়ে মাঠের ধারে দৌড়চ্ছি। হঠাৎ দেখি রাখীর স্বামী (তখন বিয়ে হয়নি) অজয় বিশ্বাস আমার কাছে হাজির। অনুরোধ করল, শুটিংয়ে অংশ নিতে। দূর থেকে উত্তমকুমার আমায় দেখছিলেন। অজয় আমার থেকে এক বছরের সিনিয়র ছিল কলেজে। ওকে বললাম, 'তুমি তো মোহনবাগান সমর্থক। জানো, আমার চোট। ফেরার চেষ্টা করছি। আমার পক্ষে এখন খেলা সম্ভব নয়।’

তা হলে উত্তমের পায়ের ওই ড্রিবলিংগুলো আসলে কার ছিল? সুকুমারের নিজের ধারণা, উত্তমকুমার বেশ ভালো ফুটবল খেলতেন। ওঁর পক্ষেও ড্রিবলিং দেখানো অসম্ভব ছিল না। ‘আর চুনীদা বা বলরাম, কাউকেই আমি দেখিনি ওখানে। অন্য অনেক প্লেয়ার ছিল। তাদেরও ড্রিবলিং হতে পারে।’

বসুশ্রী সিনেমা হলেই থাকতেন ইস্টবেঙ্গলের সুপারস্টার আমেদ খান। আমেদের ছিল তাসের নেশা। সেখানে তিনি তাস খেলতেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শ্যামল মিত্রদের সঙ্গে। তাঁকে খেলার দিনও তাসের আসর থেকে ওঠানো ছিল কঠিন। মন্টুবাবু কোনও মতে ওঠাতেন। এবং ওই সূত্রে ভানুও মাঠে যেতেন আমেদের সঙ্গে গাড়িতে। ভানুর প্রিয় যেমন ছিলেন আমেদ খান, উত্তম কুমারের তেমন চুনী গোস্বামী। ভাই তরুণ কুমারকে উনি এমনও প্রশ্ন করতেন, ‘কে বেশি জনপ্রিয়? আমি না চুনী?’

ফুটবল এবং সিনেমা তীব্র ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল মুম্বইয়েও। সেখানে কুপারেজ মাঠে শীতকালে হত রোভার্স কাপ। সে সময় আইএফএ শিল্ড, ডুরান্ড কাপের সঙ্গে রোভার্স ছিল দেশের সেরা টুর্নামেন্ট। ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে নিয়মিত যেতেন শচীন দেববর্মন, রাহুল দেববর্মন। মোহনবাগানের খেলা থাকলে যেতেন মান্না দে। মহামেডানের খেলা থাকলে দিলীপকুমার। রোভার্স ফাইনালে দিলীপ কুমার প্রধান অতিথি হয়ে হাজির, এ তো নব্বই দশকেও নিজের চোখে দেখা। মান্না দে-র একটা বিখ্যাত গল্পই রয়েছে মুম্বইয়ের ফুটবল ম্যাচ নিয়ে। যা অধিকাংশ মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের চিরচেনা। তখন মান্না শচীনদেবের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। শচীনের নানা ফাইফরমাশ খাটতে হত। অনেক কষ্ট করে চার্চগেট স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনে এসে হেঁটে কুপারেজ। যাওয়ার সময় কিপ্টেমির জন্য বিখ্যাত শচীনদেব হয়তো কলা কিনলেন কোথাও, মান্নাকে বলতেন, দামটা দিয়ে দে। কোনও মালিন্য ছিল না এর মধ্যে। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ থাকলে কুপারেজের বিখ্যাত লোহার গ্যালারিতে মান্নাকে পাশে নিয়ে বসতেন এসডি। তখন মাঠের এক দিকেই গ্যালারি ছিল।

মোহনবাগান গোল করলে শচীনের পাশে বসে চেঁচাতে পারতেন না মান্না। উৎসবও নৈব নৈব চ। ক্রুদ্ধ শচীনদেব ইস্টবেঙ্গল ফুটবলারদের বাঙাল ভাষায় গালাগাল করতে করতে মান্নাকে নির্দেশ দিতেন, ‘যা, কিছু চানা কিনে নিয়ে আয়।’ কত বার যে মান্না বলেছেন সেই গল্পটা।

লতা মঙ্গেশকর নিজেও মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে মান্না-এসডির ঝামেলার গল্প শুনিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের। ১৯৮৮ সালে ক্লাবে লতাকে আনা হবে অনুষ্ঠান করার জন্য। ক্লাবের অর্থসঙ্কট। পূর্বভারতে লতার অনুষ্ঠানের দায়িত্বে তখন ইস্টবেঙ্গল ফুটবল সচিব সুপ্রকাশ গড়গড়ি। ইস্টবেঙ্গলের নাম শুনেছেন? প্রশ্ন করলে লতা বলেছিলেন, ‘শুনব না? একবার মান্নাদা আর আমার রেকর্ডিং করাচ্ছেন শচীনদা। সে দিন মুম্বইয়ে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলা। আমাকে বসতে বলে শচীনদা মান্নাকে নিয়ে খেলা দেখতে চলে গেলেন। কে জিতল, কে হারল জানি না। ফেরার সময় দুজনে আলাদা আলাদা ফিরলেন। অপেক্ষা করে থাকলাম। রেকর্ডিং হল না।’

ওই সময় মুম্বই কাঁপাচ্ছেন বাঙালি গায়ক, সুরকার, পরিচালক, অভিনেতারা। ফুটবলাররা রোভার্স কাপে খেলতে গেলে এক একজনের বাড়িতে যেতেন। অনেকে আসতেন কোলাবায় মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের হোটেলে। এই ভাবেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এসে শুনেছিলেন ফুটবলার সুকুমার সমাজপতির গান।

১৯৬০ সাল সেটা। রোভার্স কাপে প্রথম মুখোমুখি মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল। সেমিফাইনাল ম্যাচ দেখার জন্য টিকিটের হাহাকার। মোহনবাগান টিম উঠেছিল এমএলএ হোস্টেলে। দুপুরের দিকে হঠাৎ সেখানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বিশ্বজিৎকে নিয়ে হাজির। তখন প্রত্যেক দল ডে স্লিপ পেত, অতিথিদের বিলোনোর জন্য। হেমন্তরা এসেছিলেন ডে স্লিপের জন্য। লাঞ্চের পর শৈলেন মান্না যখন হেমন্ত-বিশ্বজিতের সঙ্গে পুরো টিমের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, তখন সবাই হেমন্তকে ধরেন পুজোর হিট গান গাওয়ার জন্য। টেবিলে বসেই হেমন্ত গেয়ে শোনান, ‘অলির কথা শুনে বকুল হাসে’I

চুনীই তখন হেমন্তকে বলেন, আমাদের সুকুমার সমাজপতি খুব ভালো গান করেন। হেমন্তের অনুরোধে সুকুমারকে গান গাইতেই হয়। এবং হেমন্তর সামনে সুকুমার ধরেছিলেন মান্না দে-র গান। ‘ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে কতই খেলা’। শুনে হেমন্ত প্রশংসা করে বলেছিলেন, তুমি ভালো গান করো, রেকর্ড করতে পারো। কলকাতায় ফিরে আমার সঙ্গে দেখা করো। মেগাফোনে রেকর্ড করানোর ব্যবস্থা করে দেব। খেলা ছাড়ার পরে সুকুমার গানেই মজে ছিলেন। তবে তখন রাজি হননি। আর সেদিন ম্যাচটা জার্নেল সিংয়ের আত্মঘাতী গোলে হেরে গিয়েছিল মোহনবাগান। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা স্টপারের ঝুঁটিতে লেগে বল ঢুকে যায় গোলে।

গৃহযুদ্ধ ছবিতে অবিস্মরণীয় সুনীল মুখোপাধ্যায়।

এখন প্রশ্ন করতে পারেন, 'জন অরণ্য'-'ধন্যি মেয়ে'-'ওরা থাকে ওধারে' ছাড়া আর কোন কোন ছবিতে ফুটবল বড় ভূমিকা নিয়েছে?

সত্তরের দশকে মুক্তি পেয়েছিল দীপঙ্কর দে-রাজশ্রী বসুর ‘মোহনবাগানের মেয়ে’, সমিত ভঞ্জের ‘স্ট্রাইকার’। দুটো ছবিরই গান হিট হয়েছিল, নিয়মিত রেডিওর ছায়াছবির গানের আসরে বাজত। অনুপ ঘোষালের ‘মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলা হয়েছে’ গানটা বেশি হিট ছিল মান্না দে-র ‘প্রেম নগরে খেলতে যাবি চল’ গানের তুলনায়। স্ট্রাইকার মতি নন্দীর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস। পুরোপুরি ফুটবল ভিত্তিক লেখা। ১৯৭৮ সালের সিনেমায় সমিতের তখন পড়তি ফর্ম। চেহারাও ভারি হয়ে গিয়েছে। কেন তাঁকে নায়কের ভূমিকায় বাছলেন পরিচালক অর্চন চক্রবর্তী, সেটা প্রশ্ন। স্বয়ং মতি নন্দীকে এ নিয়ে আক্ষেপ করতে শুনেছি। তাঁর সেই আক্ষেপ পরে মেটে সাঁতার নিয়ে ‘কোনি’ ছবি সুপারহিট হওয়ার পর।

১৯৭৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পরিচালক মানু সেনের ‘মোহনবাগানের মেয়ে’ অবশ্য মূলত প্রেমের ছবি। মোহনবাগান সমর্থক তরুণীর সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল সমর্থক তরুণের সম্পর্ক নিয়ে। এখনকার দিনে এটা কোনও ব্যাপার নয়। সত্তর দশকে এটা সত্যিই আলোচনার ব্যাপার ছিল। এ ধরনের প্রেম নিয়ে পরে আর একটা ছবি হয় ঠিক কুড়ি বছর পরে। নাম, ইস্টবেঙ্গলের ছেলে। নায়ক চিরঞ্জিত, নায়িকা শতাব্দী রায়। সিনেমার চিত্রনাট্য ও সংলাপে নাম ছিল চিরঞ্জিতেরই। পরিচালক অলোক ভৌমিক।

আর একটা ফুটবল সংক্রান্ত ছবি সুপারহিট হয়েছিল তাপস পালের সেরা সময়ে। তিনি তখন যেখানে হাত দিচ্ছিলেন সোনা। ১৯৮১ সালে 'সাহেব' ছবি করলেন পরিচালক বিজয় বসু। একান্নবর্তী পরিবারে অবসরপ্রাপ্ত বাবা উৎপল দত্ত। বৌদি মাধবী চক্রবর্তী ও বোন মহুয়া রায়চৌধুরী বাদে ফুটবলার হওয়ার জন্য পাগল তাপসকে কেউ ভালোবাসে না। জোটে বিদ্রুপ। বোনের বিয়ের জন্য সব দাদারা যখন বাবাকে সাহায্য করে না, তখন তাপস নিজের কিডনি বিক্রি করে টাকা আনে। সবার অজান্তে। সে ছবিতে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিপে একটা বিখ্যাত গান ছিল— একটা কাপ, একটা শিল্ড, একটা মেডেল আমি ছাড়ব না। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের লিপে, ‘কত স্বপ্ন’, মান্না দে-র ‘ও মুখে শ্বেতচন্দনে অলকা তিলকা এঁকে দে’।

সাহেব ছবির আরও কিছু কৃতিত্ব রয়েছে, যা এখনকার বাংলা সিনেমায় দেখাই যায় না। চার বছর পরে এ ছবির হিন্দি রিমেক করেছিলেন পরিচালক অনিল গাঙ্গুলি। তাপস পালের চরিত্রটা করেন অনিল কাপুর। মাধবীর চরিত্রে রাখী। শুধু উৎপল দত্ত ছিলেন নিজের ভূমিকায়। সুরকার ছিলেন বাপী লাহিড়ি। এ ছবিতেই ছিল ‘ইয়ার বিনা চ্যায়ন কাঁহা রে’ গান।

এ ছবি আবার তেলুগুতে রিমেক হয়েছিল। নাম 'বিজেথা'। নায়ক হন চিরঞ্জীবি। কানাড়ায় রিমেক হয় 'কর্ণা' নামে। নায়ক বিষ্ণুবর্ধন। মালয়ালম ছবিতে তাপস পালের জায়গা নেন শংকর। ছবির নাম হয়েছিল 'চেক্কারন ওরু কিল্লা'।

শেষ কোন বাংলা ছবি চারটি প্রধান ভাষায় রিমেক হয়েছিল, সেটা খুঁজতে হবে অনেক কষ্ট করে।

আর একটা ফুটবল সংক্রান্ত ছবি সুপারহিট হয়েছিল তাপস পালের সেরা সময়ে। তিনি তখন যেখানে হাত দিচ্ছিলেন সোনা। ১৯৮১ সালে 'সাহেব' ছবি করলেন পরিচালক বিজয় বসু। একান্নবর্তী পরিবারে অবসরপ্রাপ্ত বাবা উৎপল দত্ত। বৌদি মাধবী চক্রবর্তী ও বোন মহুয়া রায়চৌধুরী বাদে ফুটবলার হওয়ার জন্য পাগল তাপসকে কেউ ভালোবাসে না। জোটে বিদ্রুপ। বোনের বিয়ের জন্য সব দাদারা যখন বাবাকে সাহায্য করে না, তখন তাপস নিজের কিডনি বিক্রি করে টাকা আনে। সবার অজান্তে।

২০১১ সালে মোহনবাগানের ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড জয়ের একশো বছর পূর্তিতে তৈরি হয়েছিল ‘এগারো’। পরিচালক ছিলেন অরুণ রায়। সেখানে অভিনয় করেই সবচেয়ে চোখে পড়েন প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাতি রণদীপ।

প্রায় ওই এক সময়, এক বছর আগে বাংলাদেশে তৈরি হয়েছিল ‘জাগো’ নামে একটি ছবি। পরিচালক খিজির হায়াত খান। বাংলাদেশে খেলা নিয়ে যত ছবি হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে আগে থাকতে পারে এ ছবি। অন্তত বাংলাদেশে অনেকেই কথাটা বলেন।

এ পারে কদিন আগে অভিনেতা দেবের উদ্যোগে হল ভারতীয় ফুটবলের পিতা বলে পরিচিত নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীকে নিয়ে সিনেমা। নামেই বায়োপিক। সেখানে অনেক কিছু তথ্য মেনে হয়নি।

ফুটবলারের সঙ্গে নায়িকার প্রেম? ধন্যি মেয়ে ছবিতে গ্রামের দাপুটে মেয়ে জয়া ভাদুড়ির সঙ্গে ফুটবলার পার্থ মুখোপাধ্যায়ের প্রেম ছিল একটা বড় ব্যাপার। বাস্তবে সেটাও তো কম দেখেনি কলকাতা ময়দান। অলিম্পিক অধিনায়ক, মোহনবাগানের তারকা বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় বিয়ে করেছিলেন অভিনেত্রী তপতী ঘোষকে। সেই কোন যুগে ফুটবলার অনিল দে-র সঙ্গে কার্যত লিভ টুগেদার করতেন নায়িকা অনুভা গুপ্তা। অনিলের জীবনযাপন ভালো ছিল না। পরে সে সম্পর্ক ভেঙে যায়। বহু যুগ বাদে ফুটবলার রজত ঘোষদস্তিদার যখন প্রথম বিয়ে ভাঙার পর বিয়ে করলেন অভিনেত্রী সোনালি চৌধুরীকে তখন আবার লোকমুখে ফিরে আসে অনিল দে-র গল্প।

কিংবদন্তি ফুটবলার গোষ্ঠ পালকে বলা হত চীনের প্রাচীর। সেই তিনি (ছবিতে বাঁ দিকে) তিরিশের দশকে নির্মিত গৌরীশঙ্কর ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।

ফুটবল এবং বাংলা সিনেমা নিয়ে লিখতে লিখতেই মনে হয় ইংরেজি ছবির পৃথিবীতে একটু ঘুরে আসি। সেখানে তো আরও রহস্য, আরও বৈচিত্র্য ফুটবল নিয়ে। তবে সহজ কথা হল, আমেরিকায় আমেরিকান বেসবলের তুলনায় ফুটবল তেমন জনপ্রিয় ছিলই না। প্রথম দিকে হলিউডে ফুটবল নিয়ে তেমন কোনও সিনেমাও হয়নি। ফুটবল নিয়ে প্রথম ইংরেজি সিনেমা বলা যায় ১৯৩৯ সালে তৈরি ‘দ্য আর্সেনাল স্টেডিয়াম মিস্ট্রি’। আর্সেনালের স্টেডিয়ামে এক খুনের ঘটনা নিয়ে ছবিটা। ফুটবল নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবি কী গোটা বিশ্বে? সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে, 'এসকেপ টু ভিক্টরি'। ছবিটা ১৯৮১ সালের। পরিচালক জন হস্টন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটা গল্প বেছেছিলেন। সেখানে সিলভেস্টার স্ট্যালোনের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন পেলে এবং ববি মুর। পেলেকে নিয়েই একটা সিনেমা হয়েছিল ২০১৬ সালে। 'পেলে, বার্থ অফ আ লিজেন্ড'। আমাদের দেশে এমন কোনও সিনেমা হয়নি কোনও ফুটবলারকে নিয়ে। 'বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যামে' বরং উঠে এসেছিল মেয়েদের ফুটবল। বাঙালির ফুটবলের চিনের প্রাচীর ‘গোষ্ঠ পাল’ তিরিশের দশকে একটি নির্বাক ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। পরের দিকে উমাপতি কুমার, চুনী গোস্বামী, সুব্রত ভট্টাচার্যকেও সিনেমায় দেখা গিয়েছে।

১৯৫৭ সালে একটা ছবির নামই ছিল ‘গড়ের মাঠ’। পরিচালক ছিলেন সুহৃদ ঘোষ। ছবি বিশ্বাস, অনিল চট্টোপাধ্যায়, সুমিত্রা দেবীর সঙ্গে ছবিতে ছিলেন ফুটবল মাঠের কিংবদন্তিরা। গোষ্ঠ পাল, উমাপতি কুমার, আমেদ খান, বাঘা সোম, ভব রায়, পদ্ম মিত্রর মতো অনেকে। ছবিটা চলেনি সে রকম, তার প্রিন্টও আর পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।

ধন্যি মেয়ে ছবিতে গ্রামের দাপুটে মেয়ে জয়া ভাদুড়ির সঙ্গে ফুটবলার পার্থ মুখোপাধ্যায়ের প্রেম ছিল একটা বড় ব্যাপার। বাস্তবে সেটাও তো কম দেখেনি কলকাতা ময়দান। অলিম্পিক অধিনায়ক, মোহনবাগানের তারকা বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় বিয়ে করেছিলেন অভিনেত্রী তপতী ঘোষকে। সেই কোন যুগে ফুটবলার অনিল দে-র সঙ্গে কার্যত লিভ টুগেদার করতেন নায়িকা অনুভা গুপ্তা।

বস্তুত কলকাতা নামী ফুটবলাররা কম নামেননি বাংলা সিনেমায়। ১৯৯৬ সালে চিরঞ্জিতের ইস্টবেঙ্গলের ছেলে ছবিতে নিজেদের চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, সুব্রত ভট্টাচার্য, কৃশানু দে, বিকাশ পাঁজি, কৃষ্ণেন্দু রায়, অমিত ভদ্র, বাবু মানি, অতনু ভট্টাচার্য, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, উত্তম মুখোপাধ্যায়, রঞ্জিত কর্মকার, সুখেন সেনগুপ্ত, দেবাশিস সরকার সহ একঝাঁক নামী ফুটবলার। ছবি যখন শুরু হচ্ছে, তখন টাইটেলে পিকে এবং সুব্রতর নাম নায়ক চিরঞ্জিতের সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয়েছিল। পিকে তো কথা বলায় ওস্তাদ ছিলেন। সিনেমাতেও তাঁর সংলাপ ছিল চমৎকার।

সুব্রত তাঁর ফুটবলার জীবনে টলিউডের অনেকের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতেন আগেই বলেছি। মিঠুনের মতো সাদা জামা, সাদা জুতো, সাদা প্যান্ট পরে ফাংশনে গিয়ে গান গাইতেন। সেরা সময়েও একটা সিনেমাতে অভিনয় করেছিলেন। কী সেটা? সুব্রতর নিজেরও ভালো করে মনে নেই দেখা গেল।

তবে ২০২০ সালেও সৌরভ পালের পরিচালনায় একটি সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’তে নামতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। অবসর নেওয়া এক ফুটবলারের ভূমিকায়। যিনি চান তাঁর ছেলে ফুটবলার হবে, কিন্তু ছেলে যেতে চাইছে সিনেমা লাইনে। সুব্রতর ব্যক্তিগত জীবনে ছেলে সাহেবকে নিয়ে যা হয়েছে। তবে যা হয়ে থাকে, সিনেমাটা এখনও পুরো তৈরিই হয়নি। শেষ হবে কিনা সন্দেহ।

২০১০ সালে ‘যুগ যুগ জিও’ নামে এক ফুটবল ভিত্তিক সিনেমা হয়েছিল। প্রয়াত অভিষেক চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নায়ক। সেখানেও সুব্রত অভিনয় করেছিলেন কোচের ভূমিকায়। ডোমজুড় স্টেডিয়ামে যখন অভিনেতাদের ফুটবল ট্রেনিং হচ্ছিল, তখন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসরের ভূমিকাতেও ছিলেন সুব্রত।

গড়ের মাঠ ছবিতে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের তালিকা ছিল আকর্ষণীয়।

এত এত বাক্যের পর্বত পেরিয়ে কী মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত? একটা সময় শৈলেন মান্না থেকে সুব্রত ভট্টাচার্য, ছবি বিশ্বাস থেকে উত্তমকুমার, পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে চুনী গোস্বামী, তাপস পাল থেকে দেব, সবাইকে বাংলা সিনেমায় মিলিয়েছে ফুটবল। দুটোই এককালে ছিল বাঙালির অত্যন্ত প্রাণের। কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলা সিনেমা ও ফুটবল, দুটোরই যা দুর্দশা তাতে এদের মিলনে কাঞ্চনপ্রাপ্তির প্রশ্ন নেই। আপনি পাস না অনার্স?

এই প্রশ্নের উত্তরে এখন আর কোনও বাঙালি আর বলবে না, মোহনবাগান। কেউ বলবে না, ইস্টবেঙ্গল। আজ সত্যজিৎ রায় বেঁচে থাকলে, 'জনঅরণ্য' করার সময় ওই দৃশ্যও রাখতেন না। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ও বেঁচে থাকলে উত্তম কুমারের মতো ফুটবলপাগল চরিত্র আর 'ধন্যি মেয়ে 'ছবিতে থাকত না। চোখ বন্ধ করে এই দুটো বাক্য লিখে ফেলা যায়।

প্রবীণ সাংবাদিক রূপায়ণ ভট্টাচার্য বিশিষ্ট হয়ে আছেন ক্রীড়া এবং সঙ্গীত বিষয়ে তাঁর সমান আগ্রহের কারণে। তাঁর কর্মজীবনের শুরু ১৯৮৮ সালে, 'বর্তমান' পত্রিকায়; দু'বছর পরে যোগ দেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। সেখানে ১৯৯০ থেকে ২০১২ ক্রীড়াবিভাগে কর্মজীবনে নানা ওঠানামার মধ্যেই ফুটবলের ওপর তাঁর লেখালিখি প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।'এই সময়' পত্রিকায় ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে যোগদানের আগেই রূপায়ণ ভট্টাচার্য বিশ্বের সমস্ত বড় খেলা নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছিলেন। আট বছর কাজ করার পর 'এই সময়' থেকে অবসর নিয়ে উত্তরবঙ্গ সংবাদের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তিনি। তাঁর লেখা, কাজ আর ভ্রমণের মাঝখানে তিনি ইতিমধ্যেই মান্না দে-কে নিয়ে লিখেছেন একটি বই: 'হৃদয়ে লেখো নাম'।