সুচিত্রা সেনের সঙ্গে শিখারানী বাগ
বেবি শিখা, শিখারানী আর ছোট সুচিত্রা মানে আমার বড়পিসি
তারিখ : 01-January-1970
তাঁর কবিতা পাঠ শুনে পরিচালক অগ্রদূত তথা বিভূতি লাহার পছন্দ হওয়ায় ছয় বছর বয়সী শিখারানী বাগ ১৯৪৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'সংকল্প' ছবিতে অভিনয়ের জন্য মনোনীত হন। এভাবেই শুরু হয় বাংলা চলচ্চিত্রের সেরা শিশুশিল্পীর ১৪ বছর দীর্ঘ এবং ৪০টি ছবির অভিনয় জীবন। সেই অভিনয় জীবনে তিনি স্বয়ং জওহরলাল নেহরুর প্রশংসাও পেয়েছেন। এই বছর মে মাসে শিখারানীর প্রয়াণ ঘটলেও তিনি রেখে গেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের উত্তরাধিকার, তাঁর শাস্ত্রীয় নৃত্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং এমন বহু ছাত্রছাত্রী যাঁরা তাঁর প্রজ্জ্বলিত আদর্শের অগ্নিশিখাকে আগামীর পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে দৃঢ়সংকল্প। সাংবাদিক ও লেখক শমীক বাগ তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য স্বরূপ এই নিবন্ধটিতে তাঁর বড় পিসির কাজ এবং জীবনের বহু অজানা গল্প শুনিয়েছেন।
বিএফএ এই কাজের দায়িত্ব নিল কেন
'অগ্নিপরীক্ষা' এবং 'শিল্পী'র মতন ছবিতে সুচিত্রা সেনের ছোটবেলার ভূমিকায় অভিনয় করে সকলের হৃদয় জয় করেছিলেন যে শিশুশিল্পী, সেই প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী শিখারানী বাগকে বেশির ভাগ সিনেমাপ্রেমীরাই চেনেন। তবে বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের অন্যতম সেরা নায়িকার কাছ থেকে যে উপদেশ তিনি পেয়েছিলেন সে কথা অনেকেরই অজানা। সুপরিচিত লেখক শমীক বাগ যে শিখারানী বাগের ভাইপো সে কথাও অনেকে জানেননা। এই নিবন্ধটি অভিনেত্রীর প্রতিভা এবং উত্তরাধিকারের উদ্দেশ্যে লেখকের আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সেটা ছিল ২০১৩ সালের গ্রীষ্মের এক দুপুরবেলা। আমি আমাদের চিলেকোঠার ঘরে কাজে ব্যস্ত ছিলাম আর ঠিক সেই সময় মা তাড়াতাড়ি নীচে যাওয়ার জন্য ডাক দিলেন। মা হাঁক দিয়ে বলেছিলেন, "তাড়াতাড়ি নীচে আয়, তোর বাবাকে দেখাচ্ছে"। অন্যতম জনপ্রিয় একটি স্যাটেলাইট মুভি চ্যানেলে, ১৯৪৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, অগ্রদূত পরিচালিত 'সংকল্প' নামের ছবিটি দেখানো হচ্ছিল এবং সেখানে সত্যিই ঢিলে হাফ-প্যান্ট পরিহিত নয় বছর বয়সী আমার বাবা তাঁর সংলাপ বলছিলেন। সেই দৃশ্যে, আমার বাবা প্রদীপ বাগ, যিনি ১৯৮৮- সালে মারা যান, তাঁর ঠিক পাশেই বসে ছিলেন ছয় বছর বয়সী বেবি শিখা, যিনি বাস্তব জীবনে আমার বাবার ছোট বোন, শিখারানী বাগ। আমার বড় পিসি। আমার কাছে এই ভাই-বোনকে একসঙ্গে এ ভাবে পর্দায় দেখার অভিনবত্ব শুধুই যে চমকপ্রদ ছিল তা নয়। ওঁদের পরিবার হিসেবে আমরা এই ছবিটির কথা জানতাম, যেখানে দু'জনে একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন এবং যেটি আমার বাবার অভিনীত একমাত্র ছবি।
সেই বেবি শিখা এর পরে তাঁর বিবাহ পূর্ববর্তী নাম শিখারানী বাগ হিসেবেই শিশুশিল্পী রূপে সুপ্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন। ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যাল, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কানন দেবী, মলিনা দেবী, কমল মিত্র, তুলসী চক্রবর্তী, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, সুপ্রভা সরকার, অসিত বরণ, অনুপ কুমার, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা সেনের মতো বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে কমপক্ষে আরো ৪০টি ছবিতে অভিনয় করেন। প্রায়শই আমাদের বাড়ির নৈশাহারের আড্ডার মধ্যমণি হতেন তিনি। নীলাচলে মহাপ্রভু ছবির স্ক্রিন টেস্টে অভিনেতা হতে আগ্রহী, ২০ বছরের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যদি বাতিল না হয়ে হতেন তাহলে এই তালিকায় তাঁর নামটিও যুক্ত হত। এই নিয়ে মজার ছলে বড় পিসি একবার দুঃখ প্রকাশও করেছিলেন।

'রানী রাসমণি' ছবিতে অনুপ কুমারের সঙ্গে
বহু বছর বাদে, ২০১৬ সালে, একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে ৮১ বছরের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েও পরিবেশকে সহজ করতে নির্লজ্জের মত বড়পিসির নাম নিয়েছিলাম। ওঁর গল্ফ গ্রিনের বাড়ির একতলার লাইব্রেরি-স্টাডিতে সৌমিত্র প্রথম দিকে গম্ভীর ভাবে 'হ্যাঁ' এবং 'না'তে উত্তর দিচ্ছিলেন। কিন্তু আমার বুদ্ধিতে কাজ হয়। উনি উঠে বসেন। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, ''আচ্ছা? তুমি শিখারানী বাগের ভাইপো? ও কেমন আছে? ও তো এখন বোস?" শিখারানীর নাচের স্কুলের সমাবর্তনে যাওয়ার কথাও ওঁর মনে ছিল। আমি বড় পিসিকে নিঃশব্দে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে আসল সাক্ষাৎকারে ঢুকেছিলাম। মিন্ট লাউঞ্জ পত্রিকায় প্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র ঋত্বিক ঘটকের সাথে তাঁর সম্পর্ক এবং সংঘাতের ঘটনার কথা জানানোয়, সেটি ঘিরে প্রবল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল।
আমাদের পাড়ার মুরগির মাংসের দোকানেও 'শিখারানী বাগের ভাইপো' হবার সুবাদে আমায় অন্যদের চেয়ে আগে ছেড়ে দেওয়া হত।
স্বাধীনতা পরবর্তী নেহরু জমানার দর্শকদের কাছে শিখারানীর সহ-অভিনেতাদের তালিকা যতটা বিস্ময়কর, শিখারানীর অভিনীত ছবিগুলিও ঠিক ততটাই প্রিয়। যেমন, 'মেজদিদি', 'বাণপ্রস্থ', 'নিয়তি', 'অগ্নিপরীক্ষা', 'শুভদা', 'বলয়গ্রাস', 'রাণী রাসমণি', 'শিল্পী', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'নীলাচলে মহাপ্রভু', 'সোনার কাঠি', 'সাধক রামপ্রসাদ', 'অদৃশ্য মানুষ', 'মাথুর', 'অর্ঘ্য' ইত্যাদি। তখনকার একক পর্দার প্রেক্ষাগৃহের যুগে, ভারতে জনসাধারণের জন্য টেলিভিশন চালু হবার পূর্বে, এর মধ্যে বহু ছবিই জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং বেশ কয়েকটি সুপারহিট হিসেবে পরিগণিত হয়।
বাইরে একটা চৌপায়াতে টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে বসেছিলেন স্বয়ং উত্তম কুমার। বড় পিসিকে সঙ্গে, সঙ্গে চিনতে পেরে অভিনেতা হাসিমুখে বলে ওঠেন, "এই যে"। তিনি বলেছিলেন, "তুমি কাজ ছেড়ে পালিয়ে গেলে কেন? তোমার সঙ্গে অন্য ছবিতেও কাজ করব ভেবেছিলাম"।
এই সব ছবির মধ্যে ছিল ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'অগ্নিপরীক্ষা' ছবিটি। এটিই ছিল উত্তম কুমার সুচিত্রা সেন জুটির সফল ছবির দীর্ঘ তালিকার প্রথমটি এবং এই ছবিটির হাত ধরেই ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক জুটিগুলির অন্যতম জুটিটির পথচলা শুরু হয়েছিল। 'অগ্নিপরীক্ষা' ছবিটির অভাবনীয় সাফল্যের পরে, শিখারানী আবারও উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত 'শিল্পী' (১৯৫৬) ছবিতে বালিকা বয়সের সুচিত্রা সেনের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
বহু বছর বাদে, তত দিনে অভিনয়ের পেশা থেকে সরে এসে শাস্ত্রীয় নৃত্য প্রশিক্ষক রূপে কর্মজীবন শুরু করার পরে, বিবাহিতা শিখারানী একবার টালিগঞ্জের ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে কোন কাজে গেছিলেন। বাইরে একটা চৌপায়াতে টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে বসেছিলেন স্বয়ং উত্তম কুমার। বড় পিসিকে সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পেরে অভিনেতা হাসিমুখে বলে ওঠেন, "এই যে"। তিনি বলেছিলেন, "তুমি কাজ ছেড়ে পালিয়ে গেলে কেন? তোমার সঙ্গে অন্য ছবিতেও কাজ করব ভেবেছিলাম"। আমরা বড় পিসিকে জীবনে কখনো তাঁর কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে দুঃখ করতে দেখিনি, তাঁর উচ্ছল স্বভাবই ছিল তাঁর বর্ম। কিন্তু উত্তম কুমারের এই স্মৃতিচারণের সময় কি তাঁর মধ্যে আমি দুঃখের উপস্থিতি টের পেয়েছিলাম?
তিনি ১৯৫৪- সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'বলয়গ্রাস' ছবিতে সুচিত্রা সেনের মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করলেও, 'অগ্নিপরীক্ষা' এবং 'শিল্পী' ছবিতে অল্পবয়সী সুচিত্রার ভূমিকায় তাঁর অসাধারণ অভিনয়ের জন্যই তিনি ছোট সুচিত্রা নামে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন- ছয় দশক পরে, তাঁর সাম্প্রতিকতম সাক্ষাৎকার অবধিও সংবাদমাধ্যমে তাঁকে এই পরিচয়েই অভিহিত করা হয়েছে।

'সাধক রামপ্রসাদ' ছবিতে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে
সোহরাব মোদী পরিচালিত, ১৯৫৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, বিগ ব্যানার হিন্দি 'ঝাঁসি কি রানী' ছবির হাত ধরেই বেবি শিখার অভিনয়প্রতিভা বাংলার গণ্ডি পেরিয়েছিল। এই ছবিটি সেই দশকের সবচেয়ে বেশি অর্থব্যয়ে তৈরি ছবিগুলির মধ্যে একটি ছিল এবং এটি ছিল ভারতের প্রথম রঙিন ছবি, যার চিত্রগ্রহণ করেছিলেন 'গন উইথ দ্য উইন্ড' ছবির অস্কারপ্রাপ্ত সিনেমাটোগ্রাফার, আর্নেস্ট হলার।
বহু যুগ পরেও, বাড়িতে আমরা বাচ্চারা সেই ছবির শ্যুটিংয়ের সময় বেবি শিখার লক্ষীবাঈয়ের বালিকা বয়সের চরিত্রে অভিনয়ের গল্প মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। আমাদের রক্ত-মাংসের বড়পিসি সেই সময় মাত্র নয় বছরের হওয়া সত্ত্বেও ঘোড়ায় চড়া শিখেছিলেন, হাতির পিঠে চড়তে শিখেছিলেন এবং শুঁড়ের বদলে, ভুল করে হাতির তৈলমর্দিত দাঁত ধরে তার পিঠে চড়তে গিয়ে জখমও হয়েছিলেন। তাঁর বাড়িতে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের বিভিন্ন তারকা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব যেমন আশাপূর্ণা দেবী বা নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর প্রমুখের সাথে তাঁর ডজনখানেক বাঁধানো ছবি ছিল। তার মধ্যে দিল্লির একটি হোটেলে ‘ঝাঁসি কি রানী’ প্রদর্শন ও তার রিসেপশন উপলক্ষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর সাথে তোলা বেবি শিখার ছবিটি আলাদা ভাবে নজর কাড়ে। জওহরলাল নেহরুর মতন, ১৯৪২ সালে জন্মানো আমাদের বড় পিসির জন্মদিনও ছিল ১৪ই নভেম্বর, তাই বাড়ির বাচ্চাদের অর্থাৎ আমাদের কাছে শিশুদিবস ছিল অনেক বেশি আকর্ষণীয়।
প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাবেলা দূরদর্শনে সম্প্রচারিত বাংলা ছবির গানের অনুষ্ঠান ‘চিত্রমালা’য় ‘মেজদিদি’র সেই বিখ্যাত 'প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম' গানটি বেজে উঠলেই পর্দায় গোলগাল বড়পিসিকে শাড়ি পরে গানটির সাথে মাথা দোলাতে দেখা যেত।
১৯৯০-এর দশকে উদারীকরণের মাধ্যমে ভারতের টেলিভিশনের বাজারকে মুক্ত করা হয়। এর পর থেকে বড়পিসির অনেক ছবিই বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হতে থাকে তবে সরকার পরিচালিত একমাত্র চ্যানেল দূরদর্শনে সেগুলি অনেক বেশি বার সম্প্রচারিত হত। দু'ধরনের মাধ্যমে সম্প্রচারের এই তারতম্য দিয়ে আমি শুধু যে টেলিভিশনে সাদা-কালোর গভীরতার বদলে রংবাহারি ছবির জাঁকজমকের চাহিদাকে বুঝতে পেরেছিলাম তাই নয়, সমাজের পরিবর্তিত পছন্দ, অনুভূতি এবং যাপনে প্রতিফলিত সময়ের বদলকেও উপলব্ধি করেছিলাম।
এই শিশুশিল্পীর কোনও ছবি এক গুচ্ছ স্যাটেলাইট মুভি চ্যানেলের কোনওটায় প্রদর্শিত হলে আমরা লোকের মুখে ঠিকই খবর পেতাম। কিন্তু পূর্বঘোষিত 'বড়পিসির সিনেমা' যখন দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হত, তখন প্রতিবেশী এবং আত্মীয়রা আমাদের পুরোনো সাদা-কালো ইসি টিভি ঘিরে বসে সেটি দেখতেন। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাবেলা দূরদর্শনে সম্প্রচারিত বাংলা ছবির গানের অনুষ্ঠান ‘চিত্রমালা’য় ‘মেজদিদি’র সেই বিখ্যাত 'প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম' গানটি বেজে উঠলেই পর্দায় গোলগাল বড়পিসিকে শাড়ি পরে গানটির সাথে মাথা দোলাতে দেখা যেত এবং আমরা ছোটরা কানন দেবীর পুরাতনী রীতির কণ্ঠপ্রয়োগ অনুকরণ করে নাকি গলায় গানটি গাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। সেই ঘরে বসেই বড়পিসি আমাদের খনখনে গলার গান শুনে ও উন্মাদপ্রায় কাণ্ডকারখানা দেখে হেসে লুটোপুটি হতেন। ক্রমাগত পরিবর্তনের অস্থিরতা পেরিয়ে তাঁর অভিনীত ছবিগুলির সরল আনন্দময়তা যেন সময়ের কাঁটাকে থমকে দিত।

আশি বছরের জন্মদিনে শিখারানী বাগ
আমরা এই মজার ব্যাপারটা জানতাম যে ১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'মায়ার সংসার' ছবিটিতে শিখারানী তাঁর ছোট বোন অর্থাৎ আমাদের ছোটপিসি মালা বাগের (পরবর্তী কালে মৈত্র) সঙ্গে অভিনয় করেন। ছোটপিসি সেই একবারই বড় পর্দায় অভিনয় করেছিলেন; ‘মায়ার সংসার’ বড় পিসিরও শেষ ছবি ছিল। কারণ তিনি রূপোলি পর্দার তারকাচিত জীবনযাত্রার বদলে বিয়ে এবং সংসারকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ছবিটির শ্যুটিং চলাকালীন ঊনিশ বছরের সেই মেয়েটিকে স্বয়ং ছবি বিশ্বাস সংসার শুরু করবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে, দু'বার বৈধব্যের অভিজ্ঞতার কারণে বড়পিসির সংসার পাতার চেষ্টা ছিল ক্ষণস্থায়ী ও দুর্ভাগ্যময়।
কিন্তু ২০১৩-র গ্রীষ্মের সেই সন্ধ্যায় টেলিভিশনে 'সংকল্প' ছবিটি দেখে অবাক হওয়ার বদলে আমি কেমন যেন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পঁচিশ বছর আগের এক বিজয়াদশমীর দিন, বাবা যখন চলে গিয়েছিলেন, আমি আর আমার দিদি তখনও মিডল স্কুলে পড়তাম। মোবাইল ফোন-ক্যামেরা বিহীন সেই নিষ্পাপ দশকে ভিডিও তোলা হলেও সে ভাবে সংরক্ষিত হত না বরং পারিবারিক ছবির অ্যালবামের সেপিয়া রঙেই শান্তি খুঁজে পাওয়া যেত। আমাদের সেই বাবাই টেলিভিশনের চতুষ্কোণ পর্দায় ফিরে এসেছিলেন, চলাফেরা করছিলেন, ভাবপ্রকাশ করছিলেন। এক বার ভাইফোঁটার অনুষ্ঠানে আমার বহুপূর্বে বিগত বাবাকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখার গায়ে কাঁটা দেওয়া মুহূর্তের অনুভূতির কথা জানানোর পরে বড়পিসি আমায় আলাদা করে বলেছিলেন, "তেজু (আমার ডাকনাম) এটাই সিনেমার কৃতিত্ব। এতে ভবিষ্যতের জন্য সব ধরা থাকে। আমি চলে যাবার পর, আমায় পর্দায় দেখলে আবার যেন ভয় পাস না।" ঠাট্টা আর উদ্বেগ মেশানো তাঁর কণ্ঠস্বরে, বড়পিসির স্বভাবের চিরপরিচিত দু’টি দিক স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল।
বোনকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে বড়পিসি, বাবা এবং ওঁদের মাঝের ভাই, আমাদের বড় কাকা, চন্দন প্রায়ই অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কবিতা পাঠ করতেন। সেটা তত দিন অবধি চলেছিল, যত দিন না একজন শ্রোতা চিঠিতে লিখলেন, 'আকাশবাণীতে আজকাল বাঘের উৎপাত খুব বেড়েছে'।
এই বছর মে মাসের ২২ তারিখ সকালে বড়পিসিও চলে গেলেন। বহু মাস যাবত যে রাক্ষুসে ক্যান্সার তাঁর শরীর কুরে কুরে খাচ্ছিল, তার সঙ্গে অসম লড়াইয়ের শেষে তাঁর বিরাশি বছরের শরীর পরাস্ত হয়। তিনি যেমন শান্তিপ্রিয় ছিলেন, ঠিক সে রকমই শান্ত ভাবে চলে গেলেন।
পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের তরফে যন্ত্রণাময় কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন নেওয়ার সনির্বন্ধ অনুরোধ, উপরোধ ফিরিয়ে দিয়ে তিনি অনিবার্য মৃত্যুকেই বরণ করেছিলেন। কারণ চিকিৎসায় যে ভবিতব্যকে শুধুমাত্র কিছু দিনই ঠেকানো সম্ভব, সেটা তিনি বুঝেছিলেন।
সরকারি হাসপাতালের কর্মীরা যখন নিমতলা শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর দেহটি ওপরের তলা থেকে নামিয়ে হাসপাতালের পিছন দিকে এনে রাখেন, তখন তাঁর ওই ফ্যাকাশে, ফোলাফোলা মুখেও রোজকার জীবনচর্যায় প্রতিফলিত তাঁর স্বভাবের প্রসন্ন ও শাশ্বত মাধুর্য ফুটে উঠেছিল।
বড়পিসি একবার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ১৯৪৮ থেকে ১৯৬২ সাল অবধি, তখনকার সেরা শিশুশিল্পী হিসেবে যে ১৪ বছর তিনি কাজ করেছিলেন, সেটা ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ এবং সেই সময়কার ছবিতে বাস্তবতাকেই নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তোলা হত।
এটা বোঝানোর জন্য তিনি একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। একবার শ্যুটিং চলাকালীন তিনি তাঁর ‘সুচিত্রামাসি(সেন)’কে সংলাপ বলায় সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেন। এই অনুরোধের উত্তরে সুচিত্রা পাল্টা প্রশ্ন করেন, "তুমি, তোমার সংলাপ আমায় বলতে বলছ কেন?" বাংলা ছবির শীর্ষস্থানীয়া অভিনেত্রী সেদিন বড় পিসিকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, "তুমি আমার মতন করে সংলাপ বলতে চেষ্টা করো না, তোমার নিজস্ব বলার ভঙ্গিটা খুঁজে বের করো।"

'ঝাঁসি কি রানী' ছবির শুটিংয়ে শিখারানী
আরেক বার, 'নিয়তি' ছবিতে বয়োজ্যেষ্ঠ অভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্য আগুনে পুড়ে যাওয়া একজন মানুষের চরিত্রে অভিনয় করছিলেন। তাঁর মুখটি এতটাই ভয়াবহ দেখতে লাগত, যা দেখে শিখারানী চেঁচিয়ে উঠতেন এবং যথারীতি নিজের সংলাপ ভুলে যেতেন। একদিন মেকআপ আর্টিস্ট তাঁর মুখের আদল পাল্টে ওই বীভৎস চেহারা সৃষ্টি করবার সময় ধীরাজ ভট্টাচার্য এই শিশুশিল্পীকে কোলে নিয়ে বসলেন। নব্বই মিনিট ধরে মেকআপের কৌশলের খুঁটিনাটি তিনি বড়পিসিকে বুঝিয়ে দিলেন। এই যে রক্ত, এই যে মাংস— এ ভাবে সবটা তিনি বড়পিসিকে দেখিয়েছিলেন। সিনেমার নেপথ্যের বাস্তবকে জ্যান্ত করে তোলার প্রয়াসকে সেদিন বড়পিসি চিনতে শিখেছিলেন।
বড়পিসি যখন রূপালি পর্দায় না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে সংসার জীবনে পা রাখেন, তিনি জানতেন যে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে মেয়েদের পর্দায় বা মঞ্চে অভিনয় করাকে বাঁকা চোখে দেখা হয়। একজন প্রশিক্ষিত শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী হওয়ায় তিনি নৃত্যলোক নামে ভারতীয় নৃত্য এবং সঙ্গীতের একটি স্কুল শুরু করেন। সেটা তিনি তাঁর জীবনের প্রায় শে ষদিন অবধি, পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে পরিচালনা করেছিলেন।
বড়পিসি চিরকালই ছিলেন স্বাধীনচেতা স্বভাবের। মধ্যবয়স্কা মহিলাদের মধ্যে যখন শুধু খোঁপার চল ছিল, বড়পিসির চুল ছিল ছোট করে ছাঁটা; সবাই নিয়মমাফিক শাড়ি পরলেও বড় পিসি পরতেন সালোয়ার কামিজ; মেয়েদের মধ্যে অপ্রচলিত হওয়া সত্বেও আমাদের বাড়ির অগুন্তি গান, নাটক ও কবিতার জলসায় বড় পিসি আমাদের বাবার কাছ থেকে শিখে তবলা বাজাতেন; এখানকার দর্শকদের কাছে একেবারেই অপরিচিত একটি শৈল্পিক মাধ্যম ওয়াটার ব্যালেতে এক বার তিনি নেন মুখ্যভূমিকা। নাচ, নাটক, আবৃত্তি যেটাই হোক, বাড়ির সব সদস্যের গুরু ছিলেন বড়পিসি।
বোনকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে, বড়পিসি, বাবা এবং ওঁদের মাঝের ভাই, আমাদের বড় কাকা, চন্দন প্রায়ই অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কবিতা পাঠ করতেন। সেটা তত দিন অবধি চলেছিল, যত দিন না একজন শ্রোতা চিঠিতে লিখলেন, 'আকাশবাণীতে আজকাল বাঘের উৎপাত খুব বেড়েছে'। এই শ্রোতা ব্যক্তির রসবোধের অভাব না থাকলেও বানানের দক্ষতায় ও উচ্চারণে খামতি ছিল তা বলতেই হবে।
বড় পিসি তাঁর প্রয়াণ ঘটলে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রীদের গান গাইতে এবং নাচতে বলে গিয়েছিলেন। হাসপাতালের পিছন দিকে শায়িত তাঁর দেহকে ঘিরে কয়েক জন বর্ষীয়ান ছাত্রী গান ধরার চেষ্টা করলেও তাঁদের গলা বুজে এসেছিল।
ছোটবেলায় আমি ছিলাম বড়পিসির নাট্যবিভাগের ছাত্র। রবীন্দ্র সদনে এবং তৎকালীন রাজ্যপালের সামনে রাজভবনে বড়পিসির পরিচালিত নাটক সফল ভাবে মঞ্চস্থ হতে দেখে অভ্যস্ত হওয়ায় আমিও আমাদের বাড়িতে আত্মীয়-পরিজন এবং প্রতিবেশীদের সামনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ডাকঘর' নাটকে অমলের ভূমিকায় অভিনয় করে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলাম। আমার সংলাপ বলার আগে প্রত্যেক বার আমার অত্যুৎসাহী দিদি পাশ থেকে মশার মতো ভনভন করে সংলাপগুলো প্রম্প্ট করত। একসময় বিরক্ত হয়ে, সংলাপ বলার মাঝখানে, ছয় বছরের অসহিষ্ণু আমি বলে উঠেছিলাম, "দিদিভাই, তুই থামবি?" এই শুনে সকলে হেসে লুটোপুটি। বড়পিসি হাসেননি ঠিকই, কিন্তু বকুনিও দেননি। আসলে চার দশক আগের বড়পিসির মতন আমরাও ছিলাম অভিনয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো শিশু শিক্ষার্থী।
ছোটবেলায় আমার বহু সন্ধ্যেই কাটত উত্তর কলকাতার দেশবন্ধু পার্কে, বড়পিসির নাচের স্কুলের ছাদের ঘরে, যেখানে উনি ডজন, ডজন ছাত্রীদের নাচের তালিম দিতেন। আমার দিদি-সহ অন্য ছাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে থাকত একনিষ্ঠ ছাত্র দিলীপ। একদিকে যেমন নাচের মুদ্রাগুলি এবং ভরতনাট্যমের সুরেলা সঙ্গীত 'কৃষ্ণা নি বেগানা বারো' আমায় প্রভাবিত করেছিল, অন্য দিকে পুরুষ নৃত্যশিল্পী দিলীপই বোধহয় ছিল আমার অভিজ্ঞতায় লিঙ্গভিত্তিক বিধিনিষেধ ভাঙার প্রথম দৃষ্টান্ত। মরচে ধরা সমাজে, যেখানে প্রচলিত নিয়মগুলোকে সবাই বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়, সেখানে বড় পিসি ছিলেন পরিবর্তন এবং উন্নয়নের দিশারী।

জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে শিখারানী
বড় পিসি তাঁর প্রয়াণ ঘটলে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রীদের গান গাইতে এবং নাচতে বলে গিয়েছিলেন। হাসপাতালের পিছন দিকে শায়িত তাঁর দেহকে ঘিরে কয়েক জন বর্ষীয়ান ছাত্রী গান ধরার চেষ্টা করলেও তাঁদের গলা বুজে এসেছিল। পরিবারের সকলে শোকস্তব্ধ ছিলেন। তবে একটি মোবাইল ফোনে গায়ক দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘ভরা থাক স্মৃতি সুধা’র বিষাদঘন সুরে ছোট থেকে বড় সব ছাত্রীরা বড়পিসির প্রাণহীন শরীরকে ঘিরে ধীর লয়ে নেচেছিলেন। বড়পিসির ছাত্রীদের মধ্যে বয়সে বড় অনেকেই তাঁদের নিজেদের নাচের স্কুল শুরু করেছিলেন। বড়পিসির উৎসাহে এবং শিখারানী বাগের ৫৬ বছরের নাচের স্কুল, ‘নৃত্যলোক’কে সম্মান জানিয়ে তাঁরাও নতুন স্কুলের নামের আদ্যভাগে 'নৃত্য' শব্দটি ব্যবহার করেন।
দিল্লিতে ‘ঝাঁসি কি রানী’ ছবি প্রদর্শন উপলক্ষে বেবি শিখার সাথে জওহরলাল নেহরুর আলাপ করিয়ে দেওয়া হলে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী সেই নয় বছর বয়সী অভিনেত্রীকে বলেছিলেন, "তোমার মতন আরো অনেক শিখার আলোয় আলোকিত হোক ভারত"। পণ্ডিত নেহরুর বলা এই শব্দগুলির গুরুত্ব তখন বড়পিসি বুঝতে পারেননি। তবে পরবর্তী কালে তিনি নিশ্চয়ই এর মর্ম উপলব্ধি করেছিলেন।
লেখক পরিচিতি:
শমীক বাগ একজন সাংবাদিক, লেখক এবং চিত্রগ্রাহক যিনি এর আগে দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হিন্দুস্থান টাইমস, মিন্ট এবং রোলিং স্টোন ম্যাগাজিনে কাজ করেছেন। একজন স্বাধীন লেখক এবং চিত্রগ্রাহক হিসেবে তাঁর বিভিন্ন প্রতিবেদন ক্যারাভ্যান, বিবিসি অনলাইন, আর্টিকল ১৪, হাফিংটন পোস্ট, এল, হারপার্স বাজার, আউটলুক ট্র্যাভেলার ইত্যাদি বহু পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। উনি সাধারণত আর্থ-সামাজিক সমস্যা, প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, স্বাধীন সঙ্গীত, পরিবেশ, বিকল্প এবং স্থায়ী জীবনপ্রণালী বিষয়ে লেখালিখি করেন।