এক কন্যাকে দাহ করার ঠিক পরেই মঞ্চমাতানো চরিত্রাভিনয়ে দর্শককে সম্মোহিত করেছিলেন প্রভা দেবী। তাঁর সুযোগ্য কন্যা কেতকী দত্ত নিজের প্রাপ্য সম্মান পাননি কখনো। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য কখনো বানিয়েছেন আচার, কখনো বা হস্তশিল্পের বিভিন্ন উপকরণ। নাট্যসম্রাজ্ঞী হিসেবে সুপরিচিতা সরযূবালা দেবীর অহংবোধ প্রায় ছিলনা বললেই চলে। নিজের মঞ্চাভিনয় ছাপিয়ে যখন অপর এক জুনিয়র আর্টিস্টের অভিনয় সংবাদপত্রে প্রশংসা পায়, তখন তিনি পরম যত্নে সেই জুনিয়র আর্টিস্টকে সন্দেশ খাইয়েছিলেন। সেদিনের সেই জুনিয়র আর্টিস্ট হলেন আজকের মাধবী মুখোপাধ্যায় যিনি সে যুগের বাংলার তিন শিরোমণি অভিনেত্রীর জীবনোপাখ্যান স্মৃতি রোমন্থন করলেন।
বিএফএ এই কাজটার দায়িত্ব নিল কেন?
কয়েক দশক ব্যাপী অভিনয় জীবন এবং অভিনয়ের প্রতি নিবেদিত প্রাণ সত্ত্বেও প্রভা দেবী, কেতকী দত্ত বা সরযূবালা দেবীর মত বাংলা সিনেমার প্রথম যুগের অভিনেত্রীদের জীবন এখনও পর্যন্ত বিস্মৃতির অন্ধকারে আচ্ছন্ন। তাঁদের জীবন ধারা, চরিত্রাভিনয় বা ব্যক্তি জীবনের খুঁটিনাটি সম্পর্কে খুব কম কথাই জানতে পারা যায়। এইসকল অভিনেত্রীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত নৈকট্য এবং তাঁদের আলোচনা প্রসঙ্গকে মাথায় রেখেই আমরা অনুরোধ জানিয়েছিলাম, অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় এবং কন্যা মিমি ভট্টাচার্যের এই দুর্লভ সাক্ষাৎকার আমরা যেন সংগ্রহ করে রাখতে পারি।
আগলে রাখা স্মৃতিদের হলদে হয়ে আসা পাতা উল্টে অতীতের দিকে তাকালে অনুভব করেছি যে আমি সত্যিই সৌভাগ্যবতী কারণ বাংলা চলচ্চিত্রে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য এমন সবচেয়ে গুণী ব্যক্তিদের সান্নিধ্য আমি পেয়েছি। সেরকমই তিনজন অভিনেত্রী, যাঁরা মঞ্চে বা পর্দায় তাঁদের অভিনয় প্রতিভা প্রদর্শনের পাশাপাশি জীবনের ছুঁড়ে দেওয়া প্রত্যেক পরিস্থিতিতে মাথা উঁচু করে লড়াই করেছেন, জানাব তাঁদের কথা।
প্রথমেই যাঁর কথা বলব তিনি হলেন প্রভা দেবী। আমার কর্মজীবনে দেখা সবচেয়ে দক্ষ অভিনেত্রীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। উনি ছিলেন প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী এবং নিজের স্বকীয় সত্তা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন বলেই হয়ত ওনার আত্মবিশ্বাসও ছিল প্রখর। নির্বাক এবং সবাক, দু্'যুগের ছবিতেই তিনি বিভিন্ন পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'মাতৃস্নেহ' (১৯২৩), শিশির কুমার ভাদুড়ীর 'সীতা' (১৯৩৩), প্রফুল্ল রায়ের 'পরশমণি' (১৯৩৯), প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর 'অবতার' (১৯৪১), প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'পথ বেঁধে দিল' (১৯৪৫) ছবিগুলিতে ওনার অভিনয় আমার মনে আছে।
আমার মনে আছে একবার মিনার্ভা থিয়েটারে একটি নাটকে প্রভা দেবী অভিনয় করছিলেন। তবে, নাটকটার নাম আমার মনে নেই। দুর্ভাগ্যবশত সেই সময়ই প্রভা দেবীর মেয়ে হঠাৎই মারা যায়। একজন মা হিসেবে চরম আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও তিনি কিন্তু মনের জোরে মঞ্চে উঠে অভিনয় করেছিলেন। সেই চরিত্রটি এমনই ছিল যে তাঁকে আকর্ষণীয় শারীরিক বিভঙ্গে, চোখমুখ নেড়ে সম্মোহিনী ইশারার অভিব্যক্তিতে সেটি ফুটিয়ে তুলতে হয়েছিল।
প্রথম ব্যক্তি অবাক হয়ে বলে, "মারা গেছে! তারপরেও এরকম অভিনয় করল?" এর উত্তরে সেই সঙ্গীটি মন্তব্য করে, "হ্যাঁ, আসলে এরা তো সব বেশ্যা, তাই..."
নাটকের শেষে অভিনয় সেরে যখন বেরিয়ে আসছেন তখন দর্শকদের জমায়েতের মধ্যে থেকে একজনকে তাঁর প্রশংসা করে বলতে শুনলেন, "কী ভাল অভিনয় করল না!" সেই ব্যক্তির সঙ্গী বলে ওঠে, "হ্যাঁ, দারুণ অভিনয় কিন্তু জানিস ওর মেয়ে কাল মারা গেছে।" প্রথম ব্যক্তি অবাক হয়ে বলে, "মারা গেছে! তারপরেও এরকম অভিনয় করল?" এর উত্তরে সেই সঙ্গীটি মন্তব্য করে, "হ্যাঁ, আসলে এরা তো সব বেশ্যা, তাই..."। নাটকের ম্যানেজার সব শুনতে পেয়ে প্রতিবাদ করতে এগিয়ে এলে তিনি ম্যানেজারের হাত ধরে বলেছিলেন, "না বাবা, কিছু বলনা, ওদের যা বলার ওরা তা বলেছে। আমি যা, আমি তাই থাকব।"
এই প্রসঙ্গে ওনার ব্যক্তিগত জীবনের বিষয় সম্বন্ধেও কিছু কথা জানানো প্রয়োজন। শিশির কুমার ভাদুড়ীর ভাই তারা ভাদুড়ীর সাথে ওনার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। প্রভা দেবীর জীবদ্দশায় সেই সম্পর্ক ছিল অটুট। ওনার মৃত্যুর পরেও তারা ভাদুড়ি ওনার বাড়িতেই থাকতেন। তিনি যখন গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন প্রভা দেবীর মেয়ে কেতকী-দি'ই ওনার খেয়াল রাখতেন।
'ঘটক বিদায়' ছবির শ্যুটিং চলাকালীন আমি ওনার বানানো একটা মূর্তি রবি ঘোষকে দিয়েছিলাম। উনি চ্যাপলিনের খুব ভক্ত ছিলেন। কেতকী-দি লবঙ্গ, এলাচ, ধনে ইত্যাদি দিয়ে চ্যাপলিনের সেই মূর্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন
প্রভা দেবীর মেয়ে কেতকী-দিও ছিলেন খুব বড় মাপের অভিনেত্রী। তেমনি সুন্দর ছিল তাঁর গানের গলা। এত ভাল একজন অভিনেত্রী হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু তেমন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ তিনি পাননি। সংসার চালানোর জন্য তিনি আচার বানাতেন। আমি আমি বয়াম-বয়াম সেই আচার কিনে পরিবার ও পরিজনদের দিয়েছি। ওনার হাতের কাজও ছিল অসাধারণ। মশলা দিয়ে নানান ঘর সাজানোর জিনিস বানাতেন। 'ঘটক বিদায়' ছবির শ্যুটিং চলাকালীন আমি ওনার বানানো একটা মূর্তি রবি ঘোষকে দিয়েছিলাম। উনি চ্যাপলিনের খুব ভক্ত ছিলেন। কেতকী-দি লবঙ্গ, এলাচ, ধনে ইত্যাদি দিয়ে চ্যাপলিনের সেই মূর্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন।
কেতকী দত্ত
আরেকজনের মানুষ যাঁকে চেনার অভিজ্ঞতা আমায় ঋদ্ধ করেছে তিনি হলেন সরযূবালা দেবী। বড় মনের এবং উদার মানসিকতার মানুষ হবার কারণে সবাই তাঁকে খুব সম্মান করত। আমি ওনার সঙ্গে ইংরাজি রূপকথার 'স্নো হোয়াইট' গল্পটি অবলম্বনে তৈরি 'তুষার কণা' নাটকে অভিনয় করেছিলাম। যুগান্তরে প্রকাশিত সেই নাটকের সমালোচনায় লেখা হয়েছিল "নাট্য সম্রাজ্ঞী সরযূবালা দেবীকে ম্লান করে দিয়েছে কুমারী মাধবী"।
আমি বুঝতে পারছিলামনা কেন হঠাৎ করে ওটা খেতে বলছেন। মনে, মনে সন্দেহ হল সন্দেশটা কী ভাল না! আমি একবার জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, "সন্দেশটা কী পচে গেছে?" উনি বললেন, "না, ভাল বলেই তো তোকে দিলাম। খারাপ হলে কী দিতাম?"
আমি তখন খবরের কাগজ খুব একটা পড়তাম না। রোজকার মতন সেদিনও থিয়েটারে যেতে, সরযূবালা আমায় বললেন "আয়"। আমাদের আলাদা, আলাদা ঘর ছিল। ওনার ঘরে যেতেই আমায় বললেন "বোস, সন্দেশটা খা।" দেখলাম ইয়াব্বড় একটা সন্দেশ। আমি বুঝতে পারছিলামনা কেন হঠাৎ করে ওটা খেতে বলছেন। মনে, মনে সন্দেহ হল সন্দেশটা কী ভাল না! আমি একবার জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, "সন্দেশটা কী পচে গেছে?" উনি বললেন, "না, ভাল বলেই তো তোকে দিলাম। খারাপ হলে কি দিতাম?"
সরযূবালা দেবী
সন্দেশটা খেতে শুরু করলাম। খেতে, খেতে একটু দম নেবার জন্য থামতেই উনি জিজ্ঞেস করলেন বলল, "তোকে কেন সন্দেশ খেতে দিলাম জানিস?" আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিনা যে কেন দিলেন তাই মৃদুস্বরে বললাম, "কী জানি, মনে হল তাই!" উনি বললেন কেন ওনার মনে হল সেকথা ভেবে বলতে। আমি হাজার চেষ্টা করেও বুঝতে পারলাম না কারণটা। আমার বিড়ম্বনা দেখে উনি তখন বললেন, "কাগজ পড়েছিস?" তারপরে, উনিই জানালেন যে যুগান্তরে আমাদের নাটকের সমালোচনা বেরিয়েছে। সমালোচনায় যা লেখা হয়েছে, তা শুনে লজ্জায় আমি আর মাথা তুলতে পারছিলাম না। তখনও অর্ধেক সন্দেশ খাওয়া বাকি কিন্তু লজ্জার চোটে খাওয়া মাথায় উঠেছে। উনি ছিলেন এমনই মানুষ যাঁর মধ্যে ঈর্ষা বা বিদ্বেষের লেশমাত্র ছিল না।
আমি শুনেছি উনি যখন প্রথম নাট্যজগতে পা রেখেছিলেন ওনাকে দেখে অবাক হয়ে পরিচালক মন্তব্য করেছিলেন, "এই কাকতাড়ুয়াটা আবার কোথা থেকে এল?"
মহিলা শিল্পী মহলে একসাথে কাজ করবার সময়ও উনি সংলাপ বলা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী স্বর প্রক্ষেপণের কৌশল বিষয়ে আমায় পরামর্শ দিতেন। যেমন, 'না' শব্দটা যে তিনরকমভাবে বলা সম্ভব সেটা উনিই আমায় শিখিয়েছিলেন। আমরা সেই সময় যে নাটকে অভিনয় করছিলাম সেখানে রাজপুত্র এসে আমায় ভালবাসার কথা বলবে। সরযূবালা দেবী আমায় বুঝিয়েছিলেন যে আমি তিনভাবে তাঁর সেই স্বীকারোক্তির উত্তর দিতে পারি। "তুমি আমায় ভালবাসো! তুমি আমার কী ভালবাসো যুবরাজ? আমার এই চোখ, বল? আমি এখুনি উপড়ে তোমার পায়ে দিতে পারি!", "তুমি আমায় কিসের জন্য ভালবাসো? বল, এখুনি তা তোমার পায়ে লুটিয়ে দিতে পারি", "তুমি আমার কী ভালবাসো? আমার দেহ? জীবনহীন এই দেহখানি এখুনি তোমার পায়ের তলায় বিসর্জন দিতে পারি"- এরকম বিভিন্নভাবে উনি ওই সংলাপ বলতে শিখিয়েছিলেন। ওনার সেই নিঃস্বার্থ সাহায্যের জন্য কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।
আমি শুনেছি উনি যখন প্রথম নাট্যজগতে পা রেখেছিলেন ওনাকে দেখে অবাক হয়ে পরিচালক মন্তব্য করেছিলেন, "এই কাকতাড়ুয়াটা আবার কোথা থেকে এল?" চেহারা নিয়ে এমন কদর্য মন্তব্যে ঘাবড়ে না গিয়ে উনি একের পর এক নাটকে অনবদ্য অভিনয় করতে থাকেন এবং ওনার অভিনয় বহুল প্রসংশিত হয়। ওনার অভিনয় প্রতিভাই অভিনেতা নির্মলেন্দু লাহিড়ী কে ওনার প্রতি আকর্ষিত করেছিল এবং অল্পসময়ের মধ্যে উনি সরযূবালার প্রেমে পড়ে যান। ওনারা একসাথেই থাকতেন এবং ওনাদের সন্তানসন্ততিও হয়েছিল। তারপর, একসময় সরযূবালা জানতে পারেন যে নির্মলেন্দু লাহিড়ী আরেকজনের সাথেও সম্পর্কে জড়িয়েছেন এবং তিনি গর্ভবতী। তিনি কিন্তু এই সমস্যাকে মোটেও এড়িয়ে যাননি। তিনি বরং নির্মলেন্দু লাহিড়ীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সরাসরি ওই মহিলাকে বিবাহের কথা বলেছিলেন। নিজে হাতে তিনি বিয়ের সব ব্যবস্থা করেছিলেন। নির্মলেন্দু ও তাঁর স্ত্রী'র দুটি ছেলে হয়- নবগোপাল লাহিড়ী এবং গৌরগোপাল লাহিড়ী। তাঁরা দু'জনেই সরযূবালা দেবীকে 'মা' বলে ডাকতেন।
সরযূবালা দেবী
স্নেহপরায়ণ স্বভাবের জন্য ওনার চারপাশে যতজন কমবয়সীরা থাকত তাদের প্রায় সকলেই সরযূবালা দেবীকে 'মা' বলেই ডাকত। অসামান্য অভিনয় দক্ষতার পাশাপাশি অমায়িক ব্যবহার আর মিশুকে স্বভাব ছিল ওনার চরিত্রের দু'টি বৈশিষ্ট্য। সেই সময় বয়স কম হওয়ার দরুণ কেউ আমাকে গ্রাহ্য করত না। আমার সামনেই অনেকে সরযূবালা দেবীর ব্যাপারে উল্টোপাল্টা কথা বলত। উনি কিন্তু সেসব কথায় কান দিতেন না। আমি অভিযোগ জানিয়ে বলতাম, "আপনি ওদের সঙ্গে এত ভালভাবে কথা বলছেন, কিন্তু ওরা আপনার সম্বন্ধে খারাপ কথা বলে।" উনি উত্তরে বলতেন, "বলুক না, কথাই বলেছে, কাজে তো আর করেনি।"
এই তিন মহীয়সীকেই তাঁদের সময়কালে সামাজিক অবদমনের সম্মুখীন হতে হয়েছিল কিন্তু তাঁরা আত্মমর্যাদার সাথে কোনদিন আপোষ করেননি। আমার মতে এই চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্যই একজন শিল্পী অমর হয়ে থাকেন।