নিবন্ধ

প্রথম পাতা > নিবন্ধ
সুধীর মুখোপাধ্যায়ের 'শেষ পর্যন্ত' ছবিতে বিশ্বজিৎ এবং সুলতা চৌধুরী
'সুলতার ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েনই ছিল ওর মানসিক অশান্তি আর কষ্টের কারণ'
তারিখ : 12-May-2024

উত্তম কুমারের সাথে ছবিতে অভিনয় এবং উৎপল দত্তের সাথে নাটকে অংশগ্রহণ করা এই অভিনেত্রী তখনকার দিনে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। পেশাদারী সাফল্য লাভ করলেও, অভিনেত্রী সুলতা চৌধুরীর ব্যক্তিগত জীবন ছিল সমস্যাসঙ্কুল। একটার পর, একটা তিক্ত সম্পর্ক তাঁকে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল। বাল্যবন্ধু হওয়ার কারণে মাধবী মুখোপাধ্যায় তাঁর জীবনের সব উথালপাথালের সাক্ষী। টলিউডের এই নায়িকার অজানা আখ্যান জানালেন বর্ষীয়ান অভিনেত্রী। 

বিএফএ এই কাজটার দায়িত্ব নিল কেন? 

সুলতা চৌধুরী কোন, কোন ছবিতে অভিনয় করেছেন সেকথা সিনেমাপ্রেমীরা জানলেও তিনি কেমন মানুষ ছিলেন বা তাঁর জীবনের ঘাতপ্রতিঘাতের কাহিনী সকলেরই অজানা। বিএফএ-তে আমরা একজন অভিনেতার সারবত্তা এবং তাঁর জীবনের বিবিধ ঘটনাকেও সংরক্ষণে বিশ্বাসী। বাল্যবন্ধুর জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটিতে আলোকপাত করেছেন অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় এবং তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন সুযোগ্যা কন্যা
মিমি ভট্টাচার্য। 

ছোটবেলার কথা মনে পড়লেই হাজারো স্মৃতিরা আমায় ঘিরে ধরে। আসলে প্রখর স্মৃতিশক্তি হওয়ার সুবাদে ছোটবেলার বেশিরভাগ ঘটনাই আমার ভাবলভাবে মনে আছে। তবুও, কিছু, কিছু ঘটনার স্মৃতি ক্রমে ফিকে হয়ে গেছে। 

সুলতার সাথে আমার কেমন করে বন্ধুত্ব হয়েছিল সেটাও এমনই এক ঘটনা। ওর আসল নাম ছিল মহামায়া রায়চৌধুরী। পর্দায় অভিনয় শুরু করবার পর ও 'সুলতা' নাম নিয়েছিল। আমার যদ্দুর মনে পড়ে শাড়ি পরা শুরু করবারও আগে থাকতে আমাদের বন্ধুত্ব।

'দাদা ঠাকুর' ছবিতে সুলতা চৌধুরী

আমি, সুলতা, বাসন্তী একসাথে নাচ করতাম। ওই ছোট বয়সেই আমরা অনেক নাটকে অভিনয় করেছিলাম। তখনকার দিনে প্রায়শই শখের যাত্রাপালার আয়োজন করা হত যেখানে আমাদের নেওয়া হত। আমরা বহু নৃত্যানুষ্ঠান, ব্যালে এবং দলবদ্ধ নৃত্যেও যোগ দিতাম।

তবে, সেই বিয়ে কোন দুঃস্বপ্নের চেয়ে বেশি কিছু ছিলনা। যার সাথে ওর বিয়ে হয়, সে মদ খেয়ে এসে ওকে প্রচণ্ড মারধোর করত

সুলতা আমার চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড় ছিল। কিন্তু খুব কমবয়সেই ওর বিয়ে হয়ে যায়। তবে, সেই বিয়ে কোন দুঃস্বপ্নের চেয়ে বেশি কিছু ছিলনা। যার সাথে ওর বিয়ে হয়, সে মদ খেয়ে এসে ওকে প্রচণ্ড মারধোর করত। নিজেকে বাঁচাতে ও সেখান থেকে পালিয়ে আসে। 

'শেষ পর্যন্ত' ছবিতে ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে সুলতা চৌধুরী

এরকম একটা ভয়াবহ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার প্রায় সঙ্গে, সঙ্গেই ও আবার বিয়ে করে। কিছুদিনের মধ্যে ওর সন্তানও হল। এরপর, ১৯৬০ সালে ও সুধীর মুখার্জির 'শেষ পর্যন্ত' ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করে। সেই ছবিতে ছবি বিশ্বাস, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবেন বোস ও বিশ্বজিৎ প্রমুখরা অভিনয় করেছিলেন। এতজন তাবড় অভিনেতার মধ্যেও সুলতার অভিনয় বিশেষভাবে প্রসংশিত হয়েছিল। ও নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছিল। এই ছবিতে হেমন্ত-দা'র একটা গান ছিল, 'এই বালুকা বেলায় আমি লিখেছিনু'।

এতজন তাবড় অভিনেতার মধ্যেও সুলতার অভিনয় বিশেষভাবে প্রসংশিত হয়েছিল। ও নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছিল।
এই ছবিতে হেমন্ত-দা'র সুর দেওয়া, তাঁরই  কন্ঠে দারুণ জনপ্রিয় একটা গান ছিল, 'এই বালুকা বেলায় আমি লিখেছিনু'

সুলতার অভিনয় সবার চোখে পড়ায় পরে ও অনেক ছবিতেই কাজের সুযোগ পেয়েছিল। এর মধ্যে উল্লখযোগ্য কয়েকটি হল 'দুই ভাই', 'দাদাঠাকুর', 'অবশেষে', 'তিন ভুবনের পারে', 'স্ত্রী', 'মৌচাক', 'ফুলেশ্বরী', 'বাঘ বন্দী খেলা', 'রৌদ্র ছায়া',  'নতুন তীর্থ', 'সন্ন্যাসী রাজা', 'অগ্নিশ্বর', 'সেই চোখ', 'ভোলা ময়রা', 'সুদুর নীহারিকা', 'কবিতা', 'সব্যসাচী', 'সোনার খাঁচা', 'দাদার কীর্তি', 'সুবর্ণ গোলক', 'দেবিকা' ইত্যাদি।

'বাঘ বন্দী খেলা' ছবিতে উত্তম কুমারের সঙ্গে সুলতা চৌধুরী 

কর্মক্ষেত্রে ওর যত উন্নতি হতে লাগল, ওর স্বভাবে ও চেহারায় তার সাথে, সাথেই দুঃখজনক পরিবর্তন আসতে দেখলাম। চুলগুলোকে লাল রং করে ফেলেছিল আর প্রচুর সিগারেট খেত।

আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "এত ঘন ঘন সিগারেট খাও কেন?" 

তখন উত্তরে ও বলেছিল, "আমি সিগারেট না খেয়ে থাকতে পারিনা। তোর ধোঁয়ায় কষ্ট হচ্ছে।"

আমি বললাম, "আমার ধোঁয়ায় অসুবিধা হয়না। তাছাড়া, এমন জগতেই কাজ করছি যেখানে সবই ধোঁয়াশা। সেটা কথা নয়!  আসলে তুমি অনবরত ইঞ্জিনের মতন ধোঁয়া ছাড়ছ দেখে তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছিল।"

এই কথা শুনে বলেছিল, "খাচ্ছি কী আর সাধ করে, ওই ওপরে যিনি বসে আছেন, তাঁর ইচ্ছেতেই এমন হয়েছি। আমার কী চেয়েছিলাম এরকম হতে? একদমই না। কিন্তু আজ আমি নিরুপায়..." 

এই কথা শুনে বলেছিল, "খাচ্ছি কী আর সাধ করে, ওই ওপরে যিনি বসে আছেন, তাঁর ইচ্ছেতেই এমন হয়েছি। আমার কী চেয়েছিলাম এরকম হতে? একদমই না। কিন্তু আজ আমি নিরুপায়। আমি সিগারেট খাই কারণ এটাই হয়ত আমার বিধিলিপি।"

আমাদের মধ্যে বেশ কয়েকবার এই ধরণের কথাবার্তা হয়েছিল। একদিন সুলতা আমার সাথে দেখা করতে আমার বাড়িতেও এসেছিল। ও আমায় ওর সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্কের টালমাটাল অবস্থার কথা জানিয়েছিল। আমার মনে আছে ও বলেছিল যে সেই সঙ্গীটি ওর ওপরে অত্যাচার করছিল। কীভাবে ওই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায় সেই পরামর্শ চেয়েছিল আমার কাছ থেকে। আমি এককথায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে বলেছিলাম। আমার বক্তব্য ছিল যে মানুষটি ওর জীবনে এত সমস্যার সৃষ্টি করছে, তার সাথে থাকার দরকারটা কী? সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসাই বুদ্ধির কাজ হত। 

অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের 'মৌচাক' ছবিতে রঞ্জিত মল্লিক এবং সুলতা চৌধুরী 

ও আমার সব কথা শুনে বলেছিল ওভাবে বেরিয়ে আসা যায়না। সব ভুলে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। ও আমায় স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল যে সম্পর্ক ভেঙে, সবকিছু ছেড়ে চলে আসাটা কঠিন। একসময় অবশ্য ওই সম্পর্কটা থেকে ও বেরিয়ে আসে কিন্তু আবার জড়িয়ে পড়ে অন্য এক যন্ত্রণাময় সম্পর্কে।

সেই অবসাদে কিন্তু ও দূরে চলে যায়নি।
ওর হাতে তখন অনেকগুলো ছবি ছিল। আসলে, ব্যক্তিগত জীবনের জটিলতার থেকে ও মুক্তি পেতে চেয়েছিল

স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট আর ভাঙা হৃদয়ের ভার নিয়ে শেষমেশ ও কালিম্পংয়ে চলে যায়। কাজ ছিলনা বলে সেই অবসাদে কিন্তু ও দূরে চলে যায়নি। ওর হাতে তখন অনেকগুলো ছবি ছিল। আসলে, ব্যক্তিগত জীবনের জটিলতার থেকে ও মুক্তি পেতে চেয়েছিল। ও যেমন নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিল, তেমনি পার্শ্বচরিত্রেও অভিনয় করেছে। এমনকি ছোটখাটো চরিত্রেও ও অভিনেত্রী হিসেবে আলাদা মাত্রা যোগ করে দিতে পারত। সুলতা নাটক ভালবাসত এবং নিজে উৎপল দত্তের নাট্যদলের সদস্য ছিল। ব্যক্তিগত জীবনের জন্যই ওকে এত কষ্ট পেতে হল। কালিম্পংয়ে ও একটা মোটেল খুলে সেখানেই থেকে গেল। ভৌগলিক দূরত্বের কারণে একসময় আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে যায়।

সলিল দত্তের 'স্ত্রী' ছবিতে সুলতা চৌধুরী

তারপর, একদিন খবর পেলাম ও পিজি হাসপাতালে ভর্তি। আমি সঙ্গে, সঙ্গে ওকে দেখতে গেলাম। ও খুবই দূর্বল হয়ে পড়েছিল। ওর গলার স্বর তখন প্রায় শোনাই যায়না। অনেক কষ্টে শুনতে পেলাম যে ও দুঃখ প্রকাশ করছে। ফিসফিস করে ও বলেছিল, "এই দমচাপা জায়গাটা থেকে একটা শান্তির জায়গায় পালিয়ে গেছিলাম। সেই ঠাণ্ডার দেশেই মরব ভেবেছিলাম। ওরা আমায় আবার এই অগ্নিকুন্ডে ফিরিয়ে নিয়ে এল। কিন্তু কোন লাভ হবেনা। আমি এই গরমে আর বাঁচব না।" এই ছিল আমায় বলা ওর শেষ কথা। ওর লিভার ক্যান্সার হয়েছিল, ওকে দেখে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই ও মারা যায়। 

সুলতার মতন একজন অভিনেত্রীর এই করুণ পরিণতি  বুকে বড় বাজে। সাংসারিক অশান্তি এবং দুর্বহ সম্পর্কের জেরে শহরের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে ওকে চলে যেতে হয়েছিল। এর চেয়ে বেশি দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কী হতে পারে। সুলতার হয়ত জীবনের কাছ থেকে অনেকবেশি কিছু পাওনা ছিল।




লেখক পরিচিতি

ডঃ মিমি ভট্টাচার্য দমদম মতিঝিল কলেজের একজন সহযোগী অধ্যাপিকা। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ইতিহাস ছাড়াও নারীদের সমস্যা এবং চলচ্চিত্র বিষয়ে গভীর আগ্রহের কারণে তাঁর পিএইচডি থিসিসের বিষয়বস্তু ছিল 'বাংলা সিনেমায় নারী চরিত্রের ক্রমপরিবর্তনের ইতিবৃত্ত'। বর্তমানে তিনি ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে সিনেমায় নারীর চিত্রায়নের পরিবর্তন বিষয়ে একটি বই লিখছেন। এই বিষয়ে বিভিন্ন গ্রন্থে এবং জার্নালে নিবন্ধ প্রকাশ করা ছাড়াও তিনি ন্যাশনাল আর্কাইভের উদ্যোগে তাঁর মা এবং খ্যাতনামা অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের একটি সুশ্রাব্য জীবনী প্রস্তুতের কাজেও সহায়তা করেছেন। সম্প্রতি তিনি মৃণাল সেন,অপর্ণা সেন এবং ঋতুপর্ণ ঘোষের ফিল্মে নারীর চরিত্রায়ণ বিষয়ে মেটিরিয়াল রিকোয়ারমেন্ট প্ল্যানিং (MRP)পর্ব সম্পূর্ণ করেছেন। বহুদেশে ভ্রমণ এবং মননশীল অধ্যয়নের পাশাপাশি বিভিন্ন সেমিনারে তিনি বক্তা হিসেবে যোগদান করেছেন।