যৌবনউত্তীর্ণা, প্রবীণা, প্রাক্তন অভিনেত্রীদের সাহায্যার্থেই কানন দেবী মহিলা শিল্পী মহল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রবাদপ্রতিম এই শিল্পীর জন্মদিন উপলক্ষে জনপ্রিয় অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে প্রতিষ্ঠিত হলেও কেন কানন দেবীকে মহিলা শিল্পী মহল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়
বিএফএ এই কাজের দায়িত্ব নিল কেন:
কানন দেবীর জীবন সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যাদি যথাযথভাবে সংরক্ষিত হলেও তাঁর প্রতিষ্ঠিত মহিলা শিল্পী মহলের বিষয়ে এযাবৎ বিশেষ কিছুই জানা যায়নি। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এটিই সম্ভবত একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেটি অভিনেত্রীদের জন্য অভিনেত্রীদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত হয়। বিএফএ'তে আমরা সকলেই জানতে চেয়েছিলাম যে তখনকার দিনে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটির কর্মপদ্ধতি কেমন ছিল এবং কেনই বা এটি বন্ধ হয়ে যায়। সেই যুগের অজানা কাহিনী জানানোর জন্য অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের চেয়ে বেশি উপযুক্ত আর কেউই হতে পারেনা। তাঁর সেই স্মৃতিচারণের সঙ্গী হয়েছেন তাঁরই উপযুক্ত কন্যা মিমি ভট্টাচার্য যিনি সেই সময়কার নায়িকাদের জীবন ও যাপনের সাথে ব্যক্তিগত পরিচিত হবার পাশাপাশি গবেষক হিসেবেও এবিষয়ে জানতে আগ্রহী।
কানন দেবী ছিলেন আমাদের কাছে একটা বট গাছের মতন, সবার দরকারে তিনি পাশে থাকতেন। যে যখন কোন সমস্যায় পড়েছে, কানন-দি'কে জিজ্ঞাসা করলেই তিনি সঙ্গে, সঙ্গে একটা সমাধান বের করে ফেলতেন। কানন দেবীর প্রথাগত শিক্ষার কোন ডিগ্রি ছিলনা ঠিকই কিন্তু তিনি প্রচুর বই পড়তেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ছিল অগাধ জ্ঞান। তখনো ভ্যাকুয়াম ক্লিনার বাজারে আসেনি তাই তাঁর সংগ্রহের অগুন্তি বই তিনি নিজে হাতে পরিস্কার করতেন।
জীবনের একদম গোড়া থেকেই কানন-দি'কে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। ছোটবেলায় অভাব ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। প্রথমে তাঁর বিয়ে হয় ব্রাহ্ম সমাজের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হেরম্ব চন্দ্র মৈত্রের পুত্র অশোক মৈত্রের সাথে। বৌমা একজন অভিনেত্রী এটা উচ্চশিক্ষিত শ্বশুরমশাই মেনে নিতে পারেননি। তিনি ছিলেন এমন মানুষ যিনি হয়ত স্টার থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ সেই থিয়েটারের খোঁজ করলে উল্টোদিকের রাস্তা দেখিয়ে দিতেন। কানন দেবীর সেই বিয়েটা টেকেনি, বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপরে, ১৯৪৯ সালে তিনি হরিদাস ভট্টাচার্যকে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন বাংলার রাজ্যপালের এডিসি। পরবর্তীকালে তিনিও চিত্রনির্মাণের কাজে কানন দেবীর সাথে যোগ দেন এবং পরিচালনা করাও শুরু করেন।
কানন-দি'র আত্মজীবনী পড়ে এবং অন্যান্য বহু নায়িকার জীবন কাছ থেকে দেখে আমি বুঝেছি যে কোন স্বামীই চায়না যে তাঁর স্ত্রী তাঁর থেকেও বেশি খ্যাতি অর্জন করুক। সে তিনি কানন দি'ই হন বা সুচিত্রা সেন - সকলেই বিবাহিত জীবনের এই ধরণের জটিলতার ভুক্তভোগী। কেউ, কেউ এই নিয়ে কথা বলেছেন এবং সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন। অন্যেরা পারেননি, সেই বিয়েটাই টিকিয়ে রেখেছেন।
কানন-দি'র আত্মজীবনী পড়ে এবং অন্যান্য বহু নায়িকার জীবন কাছ থেকে দেখে আমি বুঝেছি যে কোন স্বামীই চায়না যে তাঁর স্ত্রী তাঁর থেকেও বেশি খ্যাতি অর্জন করুক। সে তিনি কানন দি'ই হন বা সুচিত্রা সেন - সকলেই বিবাহিত জীবনের এই ধরণের জটিলতার ভুক্তভোগী। কেউ, কেউ এই নিয়ে কথা বলেছেন এবং সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন। অন্যেরা পারেননি, সেই বিয়েটাই টিকিয়ে রেখেছেন
জীবনের ছুঁড়ে দেওয়া সব দুঃখ-কষ্টের ঊর্ধ্বে ওঠার ক্ষমতা কিন্তু কানন-দি'র ছিল। তাঁর মত মানুষ মেলা ভার। সৌভাগ্যবশত আমি কানন দেবীকে খুব কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ পেয়েছিলাম। উনি আমাকে ভীষণ ভালবাসতেন। আমি ওনার ‘মেজদিদি’ (১৯৫০) ছবিতে অভিনয় করেছিলাম। তখন আমি খুবই ছোট। সেই থেকেই কানন দেবীর সাথে আমার চেনাশোনা। ছবিটির শ্যুটিং যে স্টুডিও তে হয়েছিল সেটা আর নেই। কানন দেবীও চলে গেছেন। সেই স্টুডিওতে তাঁর সাথে শ্যুটিংয়ের অনেক স্মৃতি আছে আমার। পাম অ্যাভিনিউয়ের কাছে, ঝাউতলা রোডের এই স্টুডিওটার নাম ছিল রূপশ্রী। অপূর্ব সুন্দরভাবে সাজানো ছিল জায়গাটা। রাস্তায় নুড়ি পাতা ছিল আর আমাদের সবারও আলাদা, আলাদা মেকআপ রুম ছিল। কানন দেবীর তো আলাদা মেকআপ রুম ছিলই। একবার ওখানে ভয়াবহ আগুন লেগে স্টুডিওটা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
ক্যালকাটা মুভিটোনের পুরো জমিটাই যে কানন দেবীর ছিল সেকথা অনেকেই জানেনা। জমিটা বিক্রি করবার সময় কানন দেবী একটাই শর্ত রেখেছিলেন যে ওই জমিতে স্টুডিও ছাড়া আর কিছু হবেনা। আইনত ওই জমিতে অন্য কোন বাড়ি তোলা যেতনা। সেই কারণেই আজও ওখানে স্টুডিওই আছে। আমার মতে ওখানে যখন নতুন স্টুডিও হল সেটার নাম কানন দেবীর নামেই রাখা উচিত ছিল। কিন্তু সেকথা কেউ ভাবেনি। এটা ভাবলেই ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব কষ্ট হয়। কিন্তু আমি আর কার কাছে সাহায্য চাইব? কেউ তো নেই!
যৌবনোত্তীর্ণা অভিনেত্রীদের যাতে কেউ অসম্মান করতে না পারে সেটা দেখাই ছিল এই প্রতিষ্ঠানের কাজ। আমরা যারা এর সদস্য ছিলাম, সকলে মিলে অনেক নাটক করেছি। নাটক করে যা আয় হত, সেই টাকা সেবামূলক কাজেই ব্যবহার করা হত
কানন দেবীর ব্যাপারে লিখতে গেলে আমায় মহিলা শিল্পী মহলের কথা উল্লেখ করতেই হবে। এটি তৈরি করা হয়েছিল প্রবীণ অভিনেত্রীদের সাহায্য প্রদান এবং অন্যান্য সেবামূলক কাজের উদ্দেশ্যে। এটি ছিল অভিনেত্রীদের উন্নয়নের জন্য তৈরি, অভিনেত্রীদের দ্বারা পরিচালিত একটি সংগঠন। যৌবনোত্তীর্ণা অভিনেত্রীদের যাতে কেউ অসম্মান করতে না পারে সেটা দেখাই ছিল এই প্রতিষ্ঠানের কাজ। আমরা যারা এর সদস্য ছিলাম, সকলে মিলে অনেক নাটক করেছি। নাটক করে যা আয় হত, সেই টাকা সেবামূলক কাজেই ব্যবহার করা হতI
আমরা অনেক নাটকেই অভিনয় করেছি। মহিলা শিল্পী মহলের 'মিসর কুমারী' নাটকে মলিনা দেবীর অসামান্য অভিনয় আমার মনে আছে। এই নাটকে তিনি আবনের ভূমিকায় অভিনয় করতেন। আবনের চরিত্রটা আসলে করতেন বিখ্যাত অভিনেতা অহীন চৌধুরী (অহীন্দ্র চৌধুরী)। তবে, মলিনা দেবী ছেলে সেজে আবনের ভূমিকায় যেমন অভিনয় করেছেন তা এককথায় অসাধারণ।
হেমন্ত-দা এবং পাহাড়ি স্যান্যালের মতন বিখ্যাত অভিনেতারা এই নাটকের প্রত্যেকটা শো দেখতে আসতেন। 'নিষ্কৃতি'তেও মলিনা দেবী দারুণ অভিনয় করেছিলেন। যতগুলো শো হয়েছে হাউজফুল, সিট পাওয়া যেত না। হেমন্ত-দা উইংসের পাশে বসে দেখতেন আর পাহাড়ি স্যান্যাল দেখতেন সিঁড়ির মধ্যে বসে। মলিনা দেবী যখন অভিনয় করতেন তাই দেখে পাহাড়ি স্যান্যাল চেঁচিয়ে বলতেন, "আহা সখি, আহা সখি, কী ভালই না করেছ!"
মানুষের তৈরি সবচেয়ে খারাপ জিনিস হচ্ছে এই রাজনীতি। এই রাজনীতিই মহিলা শিল্পী মহলকে শেষ করে দিল। আসলে, কয়েকজন ছিলেন যারা প্রতিষ্ঠানের ভেতরের ব্যাপারে নাক গলাতে শুরু করেছিলেন
মহিলা শিল্পী মহলে বহু গুণী ও প্রবীণ অভিনেত্রীর আনাগোনা ছিল। তাঁদের একটা মাসোহারা দেওয়া হত। এমনই একজন ছিলেন কুসুমকুমারী। ওনার তখন অনেকটা বয়স হয়ে গেছে। ওনার আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। পরণে থাকত শুধু একটা শাড়ি, একটা ব্লাউজ কিনে পরারও সামর্থ্য ছিলনা। কুসুমকুমারীর কথা উঠলেই মনে পড়ে যায় যে কেন ওনার নাম কুসুমকুমারী রাখা হয়েছিল। ওনার আসল নামটা আলাদা। তবে, সেই নামটা আমি জানিনা। উনি থিয়েটার করতে আসতেন একটা সাদা ঘোড়ার গাড়িতে চেপে। তখন, ঘোড়ার গাড়িরই চল ছিল। ওনার রূপে মুগ্ধ যুবকেরা সেই গাড়ির সামনে ফুল ছড়িয়ে দিত, সাদা ঘোড়া সেই ফুলের (কুসুমের) ওপর দিয়ে হেঁটে যেত। সেই থেকেই ওনার নাম হয়ে গেল কুসুম কুমারী।
কানন দেবী চেয়েছিলেন যাতে কুসুম কুমারীর মতন অভিজ্ঞ অভিনেত্রীদের বয়সকালে দারিদ্র্যের শিকার হতে না হয় । মহিলা শিল্পী মহল অনেকদিন অবধি সক্রিয় ছিল। আমার মনে আছে আমার বিয়ের আগে অবধি প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনরকমের সমস্যা ছিলনা, সবকিছু সুন্দরভাবে চলছিল। কিন্তু পরে একটা সময় ওটা বন্ধ করে দিতে হল। ভাবতেও খারাপ লাগে যে এর কারণ ছিল রাজনীতি। রাজনীতি যেখানে ঢুকে পড়ে, সেখানেই সব নিঃশেষ হয়ে যায়। মানুষের তৈরি সবচেয়ে খারাপ জিনিস হচ্ছে এই রাজনীতি। এই রাজনীতিই মহিলা শিল্পী মহলকে শেষ করে দিল। আসলে, কয়েকজন ছিলেন যারা প্রতিষ্ঠানের ভেতরের ব্যাপারে নাক গলাতে শুরু করেছিলেন।
কানন-দি'র সাথে এই আলোচনার সময় তিনি আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন আমি এসে মিটিংয়ে সক্রিয় অংশ নিলাম না। ওনার মনে হয়েছিল আমি থাকলে উনি মনে জোর পেতেন। উনি আমায় বলেছিলেন, "তুই কেন এলি না?আমার পাশে তো কেউ ছিলনা!”
কানন দেবীকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম সংগঠনটা ভেঙে দিলেন কেন, উত্তরে উনি বলেছিলেন, "আমার বাড়িতেই শুরু হয়েছিল আর আমার বাড়িতেই এটা ভেঙে দিলাম। এই রাজনীতিটা আমি পছন্দ করিনা। আমি চেয়েছিলাম মেয়েদের একটা নিজস্ব জায়গা হোক যেখানে তারা মন খুলে নিজেদের ভাবপ্রকাশ করতে পারবে। সেখানে কেউ তাদের অসম্মান করার সাহস করবেনা। আমি এই রাজনীতি করতে চাইনি। আমি বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম, তাদের এগোতে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা আমি পারলাম না।" প্রত্যেক মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম নিয়ে একটা মিটিং হত। কানন-দি'র সাথে এই আলোচনার সময় তিনি আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন আমি এসে মিটিংয়ে সক্রিয় অংশ নিলাম না। ওনার মনে হয়েছিল আমি থাকলে উনি মনে জোর পেতেন। উনি আমায় বলেছিলেন, "তুই কেন এলি না? আমার পাশে তো কেউ ছিলনা!”
প্রতিষ্ঠানটি ভেঙে দেওয়ার পরে, কানন-দি মহিলা শিল্পী মহলের জন্য রাখা সব টাকা তিনি বিভিন্ন খাতে দান করে দিয়েছিলেন যেমন টিউবওয়েল লাগানো কিংবা কুয়ো খনন। মহিলা শিল্পী মহলের সেবামূলক কাজের জন্য একটা বাড়িও কেনা হয়েছিল। পরে তিনি সেটাও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সেই বাড়িতে কেউ থাকতে চায়নি। টাকা নিতে কারোর আপত্তি ছিলনা কিন্তু অন্যদের সাথে একত্রে বসবাসে তারা অরাজি ছিল। তার পরিবর্তে তারা নিজের, নিজের বাড়িতেই থাকতে চাইত।
এর পরে কানন-দি আর এই ধরণের কাজ করার চেষ্টা করেননি। তিনি খালি বলতেন, “এটা রাজনীতির যুগ, আমি তো এই যুগের মানুষ না। আমি এদের সঙ্গে পারব না।”
অনেকেই হয়ত ভাবেন এত পরোপকারী একজন মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কানন দেবীকে কেন এরকম খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল! আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে বেশিরভাগ নারীকেই কিন্তু জীবনে নানারকমের ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে যেতেই হয়। একজন যতই দয়ালু হন বা ভাল মনের অধিকারী হন না কেন কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে তাঁকে যেতে হয়। কানন-দি’র মতন যাঁরা বড় মাপের মানুষ, তাঁদের বিপর্যয়ের কথা আমরা জানতে পারি। অন্য অনেকে হয়ত নিজেদের দুর্ভোগের কথা জানাতেও পারেননা। নিঃশব্দে জীবনের চড়াই-উতরাই পথ পেরিয়ে একদিন তাঁদের পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হয়।