নিবন্ধ

প্রথম পাতা > নিবন্ধ
একটি ছবির শুটিংয়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
সুরের সাহচর্যে: বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবিতে সঙ্গীতের ভূমিকা
তারিখ : 23-February-2024

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত যে কবি ছিলেন সে কথা সর্বজনবিদিত। তবে, তিনি যে চাইলে সুরকারও হতে পারতেন একথা তাঁর কন্যা সঙ্গীত পরিচালক অলকানন্দা দাশগুপ্ত নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। প্রখ্যাত এই পরিচালকের প্রয়াণের দু'বছর পরে, বাবার স্মৃতির বুকে কান পেতে, 'দূরত্ব' থেকে 'আনোয়ার কা আজব কিস্যা' পর্যন্ত সুরের সাথে তাঁর গভীর সম্পর্কের কাহিনী শোনালেন তাঁর কন্যা।


বিএফএ এই কাজের দায়িত্ব নিল কেন: 

এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে প্রথিতযশা এই চিত্রপরিচালকের কাজ নিয়ে এখনো অবধি সেভাবে পর্যালোচনা করা হয়নি। এই বিষয়ে প্রাপ্ত নথিবদ্ধ তথ্যাদিও পরিমাণে সীমিত। বিএফএ-র অংশ হিসেবে আমাদের মনে হয়েছে যে তাঁর সৃষ্ট চলচ্চিত্রের জগৎকে জানার এবং বোঝার জন্য অবিলম্বে ছোট হলেও একটি পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। সঙ্গীতকে কেন্দ্র করেই তাই শুরু হল আমাদের যাত্রা এবং একজন বাবার সৃষ্টির নেপথ্য কাহিনী তাঁর প্রতিভাময়ী কন্যার চেয়ে ভালভাবে আর কেই বা আমাদের জানাতে পারে? বাবার জন্মদিন উপলক্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে অলকানন্দা তাঁকে নিবেদন করেছেন নিজের তৈরি সঙ্গীত। তার পরে কোন সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে এই নিবন্ধের মাধ্যমে বাবার সুরের বোধ এবং ভাবনাকে তিনি ভাগ করে নিয়েছেন আমাদের সঙ্গে।

বাবা চাইলেই সুরকার হতে পারতেন। সুরের জগতের সাথে তাঁর ব্যক্তিসত্ত্বা এবং শিল্পীসত্ত্বার এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল। যে সিনেমা আর কবিতা ভালবাসে সে গান, ছবি, ওয়াইন, লুচি আর চকোলেট ভালবাসে না, এটা তাঁর কাছে অকল্পনীয়। তাঁর নজরে এগুলো ছিল সমগোত্রীয়। 
তবে, তাঁর মনোজগতে সুর এবং চলচ্চিত্র মিলেমিশে এমনভাবে এক হয়ে গেছিল যে সুরের গভীর বোধ প্রতিফলিত হত পরিচালনায়। কুরোসাওয়াকে ‘রশোমনে’ জাপানের ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতের পরিবর্তে র‍্যাভেলের বলেরো ব্যবহারের কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন সুরের কোন ভাষা হয়না। তাঁর এই উক্তি বাবাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। কর্মজীবনের প্রায় গোড়া থেকেই বাবা কাজের মাধ্যমে নতুন ধরণের পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রচলিত রীতি থেকে তিনি সরে আসেন। এই পরিবর্তন আমরা বেশ স্পষ্টভাবে শুনতে পাই।

'লাল দরজা' ছবির শুটিংয়ে

'দূরত্ব' ছবিটির সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্য যেখানে প্রদীপ মুখোপাধ্যায় শ্রেণীকক্ষে নাম ডাকবার সময় পর্দার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে যান আর তার সাথেই আমাদের কানে ক্ল্যাসিকাল সেতারের ধ্বনির বদলে আছড়ে পড়ে চেলোর মূর্চ্ছনা। ইম্প্রেশনিজমের প্রতি বাবার প্রগাঢ় ভালোবাসার কথা এই দৃশ্যটি দেখেই প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম। আবহ সঙ্গীতের অদ্ভুত কম্পনে এই দৃশ্যের গতিময়তারই অনুরণন। উনি উদভ্রান্তের মতন মমতা শঙ্করের দিকে দৌড়ে এগিয়ে যাওয়া অবধি নেপথ্য সঙ্গীতটি চলতে থাকে। সুর যেন চরিত্রটির মানসিক অস্থিরতাকে এই দৃশ্যে তুলে ধরেছে। ধ্বনি এবং নেপথ্যে ব্যবহৃত সুরের গুরুত্ব আমাদের কানে ধরা দেয়।

বাবার প্রিয় 'ট্রেন যাবার শব্দ' দৃশ্যে দুই চরিত্রের মধ্যের গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথনকে ঢেকে দেয়। সঙ্গীতপ্রেমী হওয়ার কারণে বাবাকে ছোটবেলা থেকেই সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। বাবার জন্ম আনারায় যেখানে সুরের সাথে আলাপ রেডিওতে সম্প্রচারিত রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং চিরাচরিত দেশীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ভাইদের সাথে তিনিও রেডিওকে ঘিরে জটলা করতেন এবং মাঝেমধ্যে সঙ্গীত শিল্পীদের তেষ্টা মেটানোর আশায় যন্ত্রটির ওপরে জল ঢেলে দিতেন। বাবা বরাবরই অন্তর্মুখী স্বভাবের। নিজের ভাবনাচিন্তার জগতেই বুঁদ হয়ে ডুবে থাকতেন। গাছের বাকলে দলবদ্ধ কীটপতঙ্গের ঐকতানে, বল গড়ানোর শব্দে, ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাকের মধ্যেও তিনি সঙ্গীত খুঁজে পেতেন। কিন্তু এতে আশ মিটত না, আরো অনেক কিছু শোনার আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর মনে। অর্থনীতি পড়ানোর সময় তিনি পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, দ্য কার্পেন্টার্স, জোয়ান বেজের রেকর্ড কেনা শুরু করেন। বাবার পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সংগ্রহটিও গতানুগতিকতার ঘেরাটোপে ধরা দেয়নি। বেটহোফেনের পাশাপাশি সেখানে ছিল শোস্তাকোভিচ, শোয়েনবার্গ, ডিবুসি এবং র‍্যাভেলের বহু রেকর্ড। এছাড়া, নিয়মিত শুনতেন পিঙ্ক ফ্লয়েড, রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং আমার মা কুন্তলা দাশগুপ্ত'র দাদু রজনীকান্ত সেনের গান।

বাবা এবং মা, দু'জনেই ছিলেন নৃত্যানুরাগী। আমার দিদি, রাজেশ্বরী, একজন ভরতনাট্যম শিল্পী আর আমার পছন্দ ছিল ওড়িশি। কিন্তু বাবা ছন্দের মাধ্যমে নিজের ভাবনাকে বিশেষ প্রকাশ করতে পারতেন না। সুরের প্রতি তাঁর অনুরাগই হয়ত এর কারণ ছিল

আসলে, বাবার মনোজগতে নানান ভাবের আনাগোনা চলতেই থাকত। ভাল গান শুনলে তিনি অভিভূত হয়ে পড়তেন। অনুভূতির এই অসহনীয় অভিঘাতকে তিনি নিজের মতন করে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। সেই ইচ্ছে থেকেই 'গৃহযুদ্ধ' তৈরি করেন এবং নিজেই সুর দেন যা সাহসী, মর্মস্পর্শী এবং কাব্যিক বলে সমাদৃত হয়। বাবা তাঁর ছবিতে এক বিশেষ ধরণের অস্তিত্বগত সঙ্কট সৃষ্টিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এই ছবিটির শুরুতে তিনি যে গংয়ের ধ্বনি ব্যবহার করেছেন তা বাস্তবের মাটিতে দাঁড়ানো চরিত্রদের অস্তিত্বের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক। এর ঠিক পরেই ভেসে আসে মর্মন্তুদ এক সুর যা বাবা, মা, দিদি আর আমার মতই যে কারো হৃদয়কে ভেঙে খানখান করে দিতে পারে। মজার ব্যাপার হল এক্ষেত্রে আমাদের এক সূত্রে বেঁধেছিলেন টি.এস এলিয়ট। তাঁর রচিত 'প্রিলিউড'-এর সেই বিখ্যাত পংক্তি মনে আছে - "হিজ সউল স্ট্রেচড টাইটলি অ্যাক্রস দ্য স্কাই"? যেন বিষাদ এবং শ্রুতিমাধুর্যের এক অতুলনীয় মেলবন্ধনে তৈরি সেই সুর।
বাবা যে ভাবে হারমোনিকার ব্যবহার করেছিলেন সেটা আমার খুব প্রিয় ছিল। অঞ্জন দত্ত এবং মমতা শঙ্কর যখন আলিঙ্গনে আবদ্ধ হন তখন সুরটি আবারও বেজে ওঠে। বাবা সঙ্গীত এবং চিত্রগ্রহণ, দু'য়ের মাধ্যমেই এটা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন যে এই দুটি মানুষের জীবন একে অপরকে ঘিরে আবর্তিত হয় না বরং আবর্তিত হয় তাদের যুগ্ম প্রেম ও বিরহকে ঘিরে।
 বাবা এবং মা, দু'জনেই ছিলেন নৃত্যানুরাগী। আমার দিদি, রাজেশ্বরী, একজন ভরতনাট্যম শিল্পী আর আমার পছন্দ ছিল ওড়িশি। কিন্তু বাবা ছন্দের মাধ্যমে নিজের ভাবনাকে বিশেষ প্রকাশ করতে পারতেন না। সুরের প্রতি তাঁর অনুরাগই হয়ত এর কারণ ছিল। 'বাঘ বাহাদুর' ছবিতে তিনি এই সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে ওঠার সিদ্ধান্ত নেন। ছবিটির গল্পের সাথে ড্রামের বাদ্যকে অত্যন্ত স্বকীয়তার সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সুরকার শান্তনু মহাপাত্রকে তিনি নির্দেশ দেন গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র 'বাঘ বাহাদুর'-এর মানসিক অস্থিরতাকে ড্রামের ছন্দের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে। আমার মনে হয় পবন মালহোত্রার মতন অদ্ভুত প্রতিভাশালী এক অভিনেতার নৃত্যের বিভঙ্গের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে সেই প্রথমবার এরকম এক অসামান্য হৃদয়স্পর্শী কাহিনী পৌঁছে গেছিল। দেখে মনে হয় যেন চরিত্রটির জীবন ও মৃত্যু, দু'ইই সেই লোকনৃত্যের ওপর নির্ভরশীল। আমার মতে এর সঙ্গে যে সুর দেওয়া হয়েছে তা গল্প অনুযায়ী একেবারে যথাযথ।

'বাঘ বাহাদুর' ছবির শুটিংয়ে

মা আর পাখিদের প্রতি মায়ের ভালবাসাকে উৎসর্গ করেই 'চরাচর' ফিল্মটি তৈরি। মা, বাবাকে জিজ্ঞেস করতেন, "লোকে যদি পাখিদের ভালইবাসবে, তবে ওদের খাঁচার মধ্যে রাখে কেন?" বাবা কেমন সুর চাইছেন সেটা সারসংক্ষেপে আমার কাকা বিশ্বদেব দাশগুপ্তকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এবং এর জন্য কোন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হবে সেই বিষয়ে দু'জনে সহমত ছিলেন যার ফলে কাজটা আরো সহজ হয়ে গেছিল। ওনারা বাঁশি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। এই ক্ষেত্রে আরো একবার তাঁরা ইম্প্রেশনিজমের কাছে ফিরে যান। পাখিদের গানকে অনুকরণের জন্য শুষিরযন্ত্রের চেয়ে ভাল আর কিছু হতে পারে না।

এই ছবিতে বাবা নৈঃশব্দ্য এবং পুনরাবৃত্তি নিয়েও পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে চেয়েছিলেন। লখার দীর্ঘশ্বাস এবং একাকীত্বকে ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি একাধিক লং পজের ব্যবহার করেন। বাবা চেয়েছিলেন এমন একটা বাঁশির সুর যেটা পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়ের সমার্থক হয়ে উঠবে। ফিল্মটির মূল সঙ্গীতটি বাবার এই ইচ্ছেপূরণ করেছিল। ছোট্ট এক মেলোডি ও কাউন্টার মেলোডির সমন্বয়ে সেটি তৈরি হয়। আর, সেটুকুই ছিল যথেষ্ট। সুরের প্রতি এই গভীর মনোযোগের কারণে ছবিটি অনায়াসে সিনেমার সর্বকালের ইতিহাসে এক অমূল্য রত্ন হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

বাবা ছিলেন দুঃসাহসী। তিনি তাঁর চেনা গণ্ডি পেরিয়ে নিজের ছবিতে বৈদ্যুতিক বাদ্যের ব্যবহারের কথাও ভেবেছিলেন। তিনি আসলে তাঁর কাহিনীতে বিভিন্ন ধরণের সঙ্গীত ব্যবহার করতে চাইতেন। তবে, সে সব ছিল বাবার প্রিয় পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ধাঁচের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। সেই কারণেই সঙ্গীতের জগতে আমার পদার্পণ। এটা কোন 
পরিকল্পনা মাফিক হয়নি

ইতিমধ্যেই ঘটে যায় আরো অনেক কিছু। তিনি আরো নানান ধরণের গান শোনেন। আরো অনেক ফিল্ম দেখেন। অনেক বই পড়েন। বাবার শোনার, দেখার, পড়ার এবং জানার ইচ্ছে মারাত্মক রকম বেড়ে গেছিল। বাবা সেই সময় ভারতীয় সমসাময়িক সিনেমার প্রচুর গান শুনতেন এবং আগামী প্রজন্ম আরো ভাল কাজ করবে এমনটা আশা করতেন। তিনি নিজেও নতুন ধরণের কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন।
বাবা ছিলেন দুঃসাহসী। তিনি তাঁর চেনা গণ্ডি পেরিয়ে নিজের ছবিতে বৈদ্যুতিক বাদ্যের ব্যবহারের কথাও ভেবেছিলেন। তিনি আসলে তাঁর কাহিনীতে বিভিন্ন ধরণের সঙ্গীত ব্যবহার করতে চাইতেন। তবে, সে সব ছিল বাবার প্রিয় পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ধাঁচের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। সেই কারণেই সঙ্গীতের জগতে আমার পদার্পণ। এটা কোন পরিকল্পনা মাফিক হয়নি।

আমার দিদি সেই সময় বাবার সহকারী হিসেবে এবং তাঁর চিত্রনাট্যের ওপর কাজ করছিল। আমি ততদিনে সুরের জগতে প্রবেশ করেছিলাম ঠিকই। কিন্তু নিজের ভাল লাগা নিয়ে কীভাবে এগোনো যায় সেটা বুঝতে পারছিলাম না।
বাবা যখন 'ওহ্/সে' এবং 'কোয়াট্রেট/ত্রয়োদশী' বানাচ্ছেন সেই সময় আমি সবে সঙ্গীত নিয়ে পড়াশোনা সম্পূর্ণ করেছি। বাবা আমায় বলেছিলেন, "শিউলি, তুমি গান নিয়ে পড়াশোনা করেছ তার মানেই এই নয় যে তুমি সুর দিতে পারবে। তুমি যদি আমার ছবিতে সুর দিতে চাও, আগে আমায় প্রমাণ করে দেখাও যে তুমি পারবে"। বাবার বলা কথাগুলোর মধ্যে কিন্তু অনেকটা স্নেহ, আশা এবং ভরসা মিশে ছিল। একসাথে কাজ করাটা একেবারেই কঠিন হয়নি। আমি চট করে ধরতে পারতাম বাবা ঠিক কী চাইছেন। আমার যা মনে হত, বাবাও সেটা বুঝতে পেরে যেতেন।

'চরাচর' ছবির একটি দৃশ্য
'ওহ্' ফিল্মটির 'ওহ্ চাঁদ' গানটিতে সুর দেবার সময় আমরা ইন্ডি সঙ্গীত নিয়ে চর্চা করেছিলাম। গানটিতে আমি কেল্টিক সঙ্গীতের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যোগ করি। পরের পর্যায়ে আমরা পুরুলিয়ার মাটির অনুপ্রেরণায় এক নতুন সুর তৈরির পণ নিয়েছিলাম। আমি জানতাম বাবা তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠার প্রত্যেকটা আঙ্গিক ছুঁয়ে না দেখা অবধি সন্তুষ্ট হবেননা। পুরুলিয়ার লোকভাষাকে তিনি নিজের বিভিন্ন সিনেমায় ব্যবহার করেছেন। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে উত্তরায়। তবে, এই বিষয়ে আমি এখনও কাঁচা তাই উত্তরার গান নিয়ে গভীর আলোচনায় যাচ্ছি না। বাবা চেয়েছিলেন সুর দেওয়ার কাজটা গোড়া থেকে আমি নিজেই করি। সেভাবেই 'একদিনও' গানটি তৈরি করি। এর সঙ্গের নৃত্যপরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন সুকল্যাণ ভট্টাচার্য। আমার মনে হয় ওহ্'য়ের সঙ্গীত বাবাকে পুরোপুরি খুশি করতে পারেনি। বাবা সুরের মাধ্যমে যে ভাবপ্রকাশ করতে চাইছিলেন সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম তাই সময় নষ্ট না করে রবীন্দ্রনাথের রচনা অবলম্বনে তৈরি 'ত্রয়োদশী'র কাজে মন দিলাম। 'ত্রয়োদশী'র প্রারম্ভিক সঙ্গীতটি ছিল ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় আমার বানানো প্রথম সুরগুলির একটি। বাবাকে এটা শোনাতে আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম।
বাবা চেয়েছিলেন সুর দেওয়ার কাজটা গোড়া থেকে আমি নিজেই করি। সেভাবেই 'একদিনও' গানটি তৈরি করি। এর সঙ্গের নৃত্যপরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন সুকল্যাণ ভট্টাচার্য। আমার মনে হয় ওহ্'য়ের সঙ্গীত বাবাকে পুরোপুরি খুশি করতে পারেনি। বাবা সুরের মাধ্যমে যে ভাবপ্রকাশ করতে চাইছিলেন সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম তাই সময় নষ্ট না করে রবীন্দ্রনাথের রচনা অবলম্বনে তৈরি ত্রয়োদশীর কাজে মন দিলাম
অনেক পরে বাবা যখন এটা শুনলেন, এতে ক্লাসিক্যাল চেলোর ব্যবহার তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছিল। পরবর্তীতে এই ধরণের বাদ্যের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা তৈরি হয়। আমার সঙ্গে বিখ্যাত ফরাসি ক্ল্যাসিক্যাল বেহালাবাদক রেনাউড ক্যাপুকোন ও তাঁর ভাইয়ের বেহালা এবং চেলোর যুগলবন্দীর জন্য ব্রাহামের রচিত ডবল কনসার্ট পরিবেশনার রেকর্ডিং দেখার সময় বাবা আমার পছন্দকে সমর্থন জানান। বাবা আগেও চেলো শুনেছেন। কিন্তু সে বারের অভিজ্ঞতা ছিল একেবারে আলাদা রকমের। সুরের বিস্তার, আদর করার ভঙ্গিতে বাদ্যযন্ত্রটিকে জড়িয়ে ধরে চেলো বাদকের সঙ্গীত পরিবেশনা - এই সবটাই বাবাকে মুগ্ধ করেছিল। চেলো যে আমাদের দু'জনেরই প্রিয় বাদ্যের অন্যতম, সে বিষয়ে আমরা সহমত ছিলাম। নিজে পিয়ানো বাজালেও, চেলোকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল।
গান রেকর্ডিংয়ে বাবা

'টোপ'-এর ক্ষেত্রে সঙ্গীতের মূল নিয়ন্তা ছিল কাহিনীর তীব্র বিদ্রূপাত্মক বক্তব্য। অসামান্য দৃশ্যাবলী, জলচর পুরুষ, নৃত্যরত শয়তান থেকে শুরু করে রুখু প্রকৃতির নজরকাড়া প্রেক্ষাপটে দরজার শূন্য কাঠামো ঘিরে 'কে নিবি ফুল' - সিনেমার প্রত্যেক মুহূর্তের অপূর্ব সৌন্দর্য আমায় অভিভূত করেছিল। 'আমেরিকান বিউটি' ছবির বিখ্যাত দৃশ্যে অভিনেতা কেভিন স্পেসির মতন আমিও এক্ষেত্রে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। এত সুন্দর একটি সিনেমায় কিভাবে যথোপযুক্ত সুর দেব সেটাই বুঝতে পারছিলাম না।
 - "কী করি বলো তো, বাবা?"
-"গল্পের সাথে এমন এক বিষণ্ণ সুর দাও যেটা ছোট্ট মেয়েটা যে কাশবনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যায় তার অদ্ভুত স্তব্ধতাকে ফুটিয়ে তুলতে পারে।"
কাজ শুরু করবার জন্য বাবার বলা এই কথাগুলোই ছিল যথেষ্ট। আমি প্রথমে ওই দৃশ্যটিতেই সুর দিয়েছিলাম। চেলোর শিহরণ জাগানো পিজিক্যাটো দিয়ে শুরু টোপের নোম্যাড থিমটি শ্রোতাদের টেরই পেতে দেয় না যে এর পরে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। চেলোর সুরটি লেগাটোর নকশী বুনে এগিয়ে চলে। সুরের চলনের প্রথম ধাপটি যেন একটি বিবৃতি বা প্রশ্ন স্বরূপ এবং ঠিক পরের অংশটিতে তার উত্তর ও কাউন্টার মেলোডি। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করতাম যে এই সুরের সারাৎসার ভয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নাকি নিখাদ সৌন্দর্য দ্বারা অনুপ্রাণিত? এই সুর যেন বাতাসের স্তব্ধ উপস্থিতির মতন। এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে জেমস জয়েসের ‘আরাবি’ গল্পের কিশোরের অনুভূতি বোঝানোর জন্যে ঘরের বর্ণনায় ব্যবহৃত সেই শব্দগুলি: 'দ্য এয়ার ওয়াজ হাং'। চেলোর সুরটিতে সেই জগতেরই প্রতিফলন পাওয়া যায়। আমরা লোকগীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিলাম তাই দোতারা এবং বাঁশির বহুল ব্যবহার করা হয়েছিল।

'টোপ'-এর ক্ষেত্রে সঙ্গীতের মূল নিয়ন্তা ছিল কাহিনীর তীব্র বিদ্রূপাত্মক বক্তব্য। অসামান্য দৃশ্যাবলী, জলচর পুরুষ, নৃত্যরত শয়তান থেকে শুরু করে রুখু প্রকৃতির নজরকাড়া প্রেক্ষাপটে দরজার শূন্য কাঠামো ঘিরে 'কে নিবি ফুল' - সিনেমার প্রত্যেক মুহূর্তের অপূর্ব সৌন্দর্য আমায় অভিভূত করেছিল

এই আবহ সঙ্গীতের মাধ্যমে আমি বাবার 'বাঘ বাহাদুর'-এর সেই বাঘ (বাঘের জন্য ব্যবহৃত আবহ) এবং 'গৃহযুদ্ধ'র প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়েছিলাম। সেই কারণেই আমার সুরের একপ্রান্তে যেমন আছে মন্দ্র ছন্দের কলকা, অন্য প্রান্তে আছে গংয়ের অপার্থিব ধ্বনি। যে সত্য থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য বাবা বাস্তবের এক ভিন্ন রূপ সৃষ্টি করেছিলেন, এই সুর সেই সত্যকেই মনে করিয়ে দেয়। এই আলোচনায় ইতি টানবার আগে তাঁদের কথা বলতে চাই যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। ফেরায় ব্যবহৃত মোজার্টের ঘরানার বাঁশির আবহটি তৈরি হয়েছিল জ্যোতিষ্ক দাশগুপ্ত আর বাবার যৌথ প্রচেষ্টায়। চেলোই হোক বা বাঁশি, সেই সুরের মধ্যে বাবার জাদু এবং শান্তির প্রতি গভীর টান আমরা অনুভব করতে পারি। প্রথম কাহিনীতে যেখানে ছেলেটি গাছের আড়াল থেকে শেয়ালদের লক্ষ্য করে, সেখানে আকিরা কুরোসাওয়া'স 'ড্রিমস'-এর মতন অতিপ্রাকৃত ভাব ফোটাতে চেষ্টা করেছিলাম। উড়োজাহাজের ভৌতিক নৃত্যের দৃশ্যেও এই ভাব সুস্পষ্ট। আমি ঠিক পাখির শিসের মতন উইন্ড অ্যাকম্পানিমেন্ট তৈরি করি আর তার পরেই শোনা যায় এক অতিপ্রাকৃত সুর যা ওই দৃশ্যের সাথে মানানসই।

'আনোয়ার কা আজব কিসসা' ছবির একটি দৃশ্য

'আনোয়ার কা আজব কিসসা'য় যখন আনোয়ারকে ব্রিজের ওপর থেকে নিচের অসীম শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়, সেখানেও সুরের মাধ্যমে একই ভাবে দৃশ্যের ভাবটি ফুটে উঠেছে। তবে, সেক্ষেত্রে আবারও ফিরে গেছিলাম চেলোর কাছে। আমি যতগুলো ছবিতে সুর দিয়েছিলাম তার মধ্যে ‘আনোয়ার’ ছিল বাবার সবচেয়ে পছন্দের। 'হাট্টিমাটিম টিম'-এর মতন মজাদার গানের পাশাপাশি হিন্দি গানের প্রতি বাবার ভালোবাসার কথা মাথায় রেখে 'মুসকুরাহ্' গানটি তৈরি করা হয়। বাবার তৈরি ফিল্মে সুরই ছিল মুখ্যচরিত্র তাই বিদ্রূপ, নীরবতা কিংবা একাকীত্ব বারংবার ফুটে উঠেছে কোন একক বাদ্যের সুরের মূর্চ্ছনায়। বাবা কখনোই দুটি জগতকে আলাদা চোখে দেখেননি। আমি মনে করি, অনুভব করি এবং এটা আমার আন্তরিক বিশ্বাস যে বাবা চাইলেই সুরকারও হতে পারতেন।

লেখক পরিচিতি
মুম্বইনিবাসী সঙ্গীত পরিচালক অলকানন্দা দাশগুপ্ত, কবি ও পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর কন্যা। তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইংরাজি সাহিত্যে বি. এ অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এরপরে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করবার সময় তিনি টরন্টোতে তাঁর ভালবাসার বিষয় সঙ্গীত নিয়ে পড়বার সুযোগ পান এবং সেখানকার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে থিওরি ও কম্পোজিশন বিষয়ে ব্যাচেলর অফ মিউজিক উইথ অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। অলকানন্দা সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়ালেও স্বাভাবিকভাবেই ক্রমে চলচ্চিত্রে সুরপ্রদানের দিকে ঝোঁকেন। 'শালা' এবং 'ফ্যানড্রি'র মতন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মারাঠি ছবিতে কজের নেপথ্যে ছিল বিভিন্ন ধারার সঙ্গীতের প্রতি তাঁর তীব্র অনুরাগ। ২০১৩ সালে আয়োজিত মুম্বাই কম্পোজার্স ল্যাবে যোগদানের জন্য নির্বাচিত পাঁচজনের মধ্যে তিনিও ছিলেন। শ্রেষ্ঠ আবহ সঙ্গীতের জন্য তিনি ২০১২ সালে প্রভাত পুরস্কার এবং ২০১৪ সালে সংস্কৃতি কলা দর্শন পুরস্কার পান। ২০১৬ সালে বার্লিনে আয়োজিত বার্লিনেল ট্যালেন্টসের মিউজিক কম্পোজার ও সাউন্ড স্টুডিও বিভাগে যোগ দেবার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তিনি 'ট্র্যাপড' কাহিনীচিত্রটির জন্য আবহ এবং গান তৈরি করেন। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে, নেটফ্লিক্স অরিজিনাল সিরিজ 'স্যাক্রেড গেমস ওয়ান ও টু'য়ে সুরপ্রদান করেন তিনি। ২০২০ সালে তিনি 'এ.কে ভার্সেস এ.কে' ছবিতে সুর দেন এবং 'স্যাক্রেড গেমস টু'য়ের জন্য শ্রেষ্ঠ আবহ সঙ্গীত বিভাগে ফিল্মফেয়ার পান। ২০২২ সালে ভারতের অন্যতম বাফটা ব্রেকথ্রু আর্টিস্টের স্বীকৃতি পান তিনি। তাঁর সাম্প্রতিকতম কাজের মধ্যে উল্লখযোগ্য দুটি ফিল্ম হল 'জুবিলি' (২০২২) এবং 'দ্য জেঙ্গাবুরু কার্স' (২০২৩)। তিনি সম্প্রতি 'স্যাক্রেড গেমস' এবং 'জুবিলি'র জন্য বেস্ট স্কোর ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়াও, 'থ্রি অফ আস' ফিল্মটির জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের মনোনয়ন পেয়েছিলেন।